

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শের-ই-বাংলা হলে আবরার ফাহাদ নামের ২১ বছর বয়সী এক ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তার হত্যাকাণ্ডটি ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং চাঞ্চল্যকর, যা বাংলাদেশের সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে ৭ অক্টোবর চকবাজার থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ। মাত্র ৩৭ দিনের মধ্যে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত শেষ করে ১৩ নভেম্বর চার্জশিট দাখিল করে।
এই হত্যাকাণ্ডটি ছিল বুয়েট ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে, যারা আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু বিষয়ে প্রশ্ন তোলার কারণে নির্যাতন চালায়। হত্যার কারণ হিসেবে আবরারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তিনি একটি মেসেজ শেয়ার করেছিলেন যা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। এটি তার উপর অমানবিক নির্যাতনের কারণ হয়। তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করার আগে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়েছিল।
মামলার বিচারিক পর্যায়:
২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন। বিচারক তার রায়ে বলেন, আসামিরা পরিকল্পিতভাবে আবরারকে হত্যা করেছে এবং এটি ছিল একটি অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ।
আসামিদের মৃত্যুদণ্ড এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড:
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে বুয়েট ছাত্রলীগের বিভিন্ন শীর্ষ নেতা-কর্মী ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন:
- মেহেদী হাসান রাসেল (সাধারণ সম্পাদক, সিই বিভাগ, ১৩তম ব্যাচ),
- মেহেদী হাসান রবিন (সাংগঠনিক সম্পাদক, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ),
- অনিক সরকার অপু (তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ),
- মনিরুজ্জামান মনির (সাহিত্য সম্পাদক, ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ),
- মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (ক্রীড়া সম্পাদক, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ),
- ইফতি মোশাররফ সকাল (উপসমাজসেবা সম্পাদক, বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ),
এছাড়া আরও অনেক ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন যারা এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিলেন।
এদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে আদালতে প্রমাণিত হয় যে তারা আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, যা তাকে শ্বাসরোধে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা:
এদের মধ্যে ছিলেন:
- মুহতাসিম ফুয়াদ (সহ-সভাপতি, সিই বিভাগ, ১৪তম ব্যাচ),
- ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক, মেকানিক্যাল, তৃতীয় বর্ষ),
- অমিত সাহা (আইনবিষয়ক উপসম্পাদক, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং),
- আকাশ হোসেন (সিই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ),
- মোয়াজ আবু হোরায়রা (সিএসই, ১৭ ব্যাচ)।
এ মামলায় ২০২২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হয় এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়। এই রায়ের সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কে বি রুমি, জহিরুল ইসলাম সুমন, নূর মোহাম্মদ আজমী এবং সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার সুমাইয়া আজিজ উপস্থিত ছিলেন। আসামিপক্ষে আইনজীবী ছিলেন মাসুদ হাসান চৌধুরী ও আজিজুর রহমান দুলু।
হাইকোর্টের রায় ঘোষণার পর, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের বেঞ্চ ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন।
প্রসঙ্গত, গত বছর অক্টোবর মাসে আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স দ্রুত শুনানির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং দ্রুত বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে আদালতের নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন।