
ড. মুহাম্মদ ইউনুস: বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া একমাত্র গ্লোবাল সেলিব্রেটি
ড. মুহাম্মদ ইউনুস বাংলাদেশের এক গর্বিত সন্তান, যিনি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সমাজকল্যাণী, অর্থনীতিবিদ এবং নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি মাইক্রোফাইন্যান্স এবং গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পুরো পৃথিবীতে নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক এখনও বিশ্বের বহু উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি রোল মডেল হয়ে রয়েছে। তবে, তাঁর জীবনের গল্প শুধু ব্যাংকিং বা অর্থনীতির সাথে সীমাবদ্ধ নয়; এটি সমাজের অবহেলিত, দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া জনগণের জন্য এক অন্তহীন সংগ্রামের কাহিনী।
২০০৬ সালে, ড. মুহাম্মদ ইউনুস এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংককে সম্মানিত করা হয় নোবেল শান্তি পুরস্কার দিয়ে। তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয় কারণ তিনি স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে অর্থের অ্যাক্সেস পৌঁছে দিতে পেরেছেন, যা তাদের জীবনমান উন্নত করতে সহায়তা করেছে। গ্রামীণ ব্যাংক আদতে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করার মাধ্যমে দরিদ্র জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রেখেছে। যদিও তাঁকে নিয়ে নানা বিতর্ক হয়েছে, তবুও তাঁর এই অর্থনৈতিক মডেল বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।
ড. ইউনুসের অর্জন শুধু নোবেল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কারগুলির মধ্যে প্রেসিডেন্সিয়াল এওয়ার্ড (USA) এবং মার্কিন কংগ্রেশনাল এওয়ার্ডও পেয়েছেন। এই ৩টি পুরস্কার একসাথে অর্জনকারী ১২ জনের মধ্যে তিনি অন্যতম। বিশ্বের ইতিহাসে এতটা সম্মানিত হওয়ার অভিজ্ঞতা খুব কম মানুষই অর্জন করেছেন।
এছাড়া, ২০২০ সালের জাপান অলিম্পিক গেমস-এ মশাল বাহক হিসেবে ড. ইউনুস অংশগ্রহণ করেছিলেন, যা তাঁর জন্য আরেকটি সম্মানজনক অর্জন। এই অলিম্পিকে মশাল বহন করার সুযোগ পেয়ে তিনি পুরো পৃথিবীর কাছে এক অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছিলেন।
বর্তমানে, বিশ্বের ১০৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুহাম্মদ ইউনুস সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা তার মাইক্রোফাইন্যান্স মডেলের প্রতি সম্মান জানিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ড. ইউনুসের দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষা গ্রহণ করে, যা তাঁদের জীবনে সামাজিক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে সহায়ক। ইউনুসের চিন্তাধারা এমনভাবে প্রসারিত হয়েছে, যেন এটি এখন বিশ্বব্যাপী একটি আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সাথে পরিচিত হয়েছেন বিশ্বের একাধিক প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব, যাদের মধ্যে অন্যতম বিল গেটস। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস নিজে গাড়ি চালিয়ে সিলিকন ভ্যালিতে ড. ইউনুসকে পুরো শহরটি ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন, যা ছিল এক বিরল সম্মান।
এছাড়া, বিচারিক এবং আইনি চ্যালেঞ্জগুলোও তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। এক সময়ে, তাঁকে কোর্ট-কাছাড়িতে হাজিরা দিতে হতে হয়েছিল, যেখানে ৮২ বছর বয়সে তাঁকে ৮ তলায় হাঁটতে হাঁটতে যেতে হতো কারণ কোর্টের লিফট বন্ধ করে দেওয়া হতো। তিনি প্রায় ৪০ বার এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। এসব ঘটনা ড. ইউনুসের ধৈর্য, নিষ্ঠা এবং মানবিকতা প্রমাণিত করে।
ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে বহুবার ‘সুদখোর’ বলে আক্রমণ করা হয়েছে, বিশেষ করে তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে। তবে এটি একটি ভুল ধারণা। আসলে, গ্রামীণ ব্যাংক কোনো সুদের ব্যবসা চালায় না, বরং এটি ক্ষুদ্র ঋণ দেয় এবং সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল হয়ে সঠিক পথে ঋণ গ্রহীতাদের সহায়তা করে। তিনি কখনোই ব্যাংকটির কোনো শেয়ার বা মালিকানা গ্রহণ করেননি, এবং তাঁর উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র দরিদ্র মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা আনা।
ড. ইউনুসের মতে, ক্ষুদ্র ঋণ একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে, যা দরিদ্র জনগণের জীবনে পরিবর্তন আনতে সক্ষম। তাঁর মাইক্রোফাইন্যান্স ধারণাটি আজকে একটি প্রমাণিত মডেল হিসেবে গোটা পৃথিবীজুড়ে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ড. ইউনুসের মাইক্রোফাইন্যান্স ধারণা এবং তাঁর সামাজিক উদ্ভাবনী কাজের জন্য বিশ্বের নামকরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁকে সমর্থন এবং প্রশংসা দিয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইউনুস সেন্টার আজ বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গবেষণা ও শিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে সামাজিক উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনুস একটি অনন্য ব্যক্তিত্ব যিনি শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী মানবিক কাজে অবদান রেখেছেন। তাঁর জীবন ও কাজের মাধ্যমে আমরা শিখতে পারি যে, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সহানুভূতি এবং সমবেদনাই হতে পারে একটি উন্নত সমাজ গড়ার মূল স্তম্ভ। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, পৃথিবীতে পরিবর্তন আনার জন্য কোনো বড় সম্পদ বা ক্ষমতার প্রয়োজন নেই, বরং সত্যিকারের ইচ্ছা, নৈতিকতা এবং নিষ্ঠা প্রয়োজন। তাঁর কাজ আজও মানুষের জীবন পরিবর্তন করছে, এবং ভবিষ্যতেও এটি অব্যাহত থাকবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনুস আজও আমাদের গর্ব, আর তাঁর ইতিহাস শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সারা বিশ্বের জন্য এক অমূল্য সম্পদ।
নাতাশা মুন্নি