০৩:৫৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ২৪ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গাজার বেদনাদায়ক নীরবতা: মুসলিম বিশ্বের অব্যক্ত ব্যর্থতা।

বিশ্ব ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে গাজা অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতি। একটি মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিফলন যেখানে, মুসলিম বিশ্বের শক্তি ও ক্ষমতা একদিকে ছিল, কিন্তু গাজার রক্ষার্থে কোনও কার্যকর পদক্ষেপই দেখা যায়নি।

পাকিস্তান, যেটি বিশ্বের অন্যতম পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, তবুও গাজার ওপর হামলা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটিও পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করা হয়নি। এটি কি কেবল অস্ত্রের মহাকাব্যিক শক্তির প্রতি বিশ্বাস ছিল, নাকি আসল চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে অপর্যাপ্ত সাহস? ইতিহাসের পাতা গুলো কি শুধু ক্ষমতার দম্ভ ও প্রকৃত সহানুভূতির অভাবের সাক্ষী হয়ে থাকবে?

এদিকে, মিশর যা হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়ে নীলনদের তীরে দাঁড়িয়ে, সেই দেশও কোনও কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি। যখন গাজার শিশুরা তৃষ্ণায় কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল, তখন মিশরের সমুদ্রতীরের এক প্রান্তে বিশাল বিলাসবহুল সসানদের রাজত্ব চলছিল। নীলনদের প্রবাহ কখনও গাজার শুকনো মাটিতে পৌঁছায়নি, আর গাজার জন্য সহানুভূতি আসেনি।

তেলের সাগরের রাজ্য সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতও নিরব ছিল। সেই অঞ্চলের আর্থিক সম্ভাবনা বিশাল, তবে গাজার জন্য তারা কিছুই করেনি। গাজার অ্যাম্বুলেন্সগুলো পেট্রোলের অভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল নিরুপায়। এমন একটি দৃশ্য, যেখানে সহানুভূতির পরিবর্তে সম্পদ আর শক্তির আধিক্য ছিল, কিন্তু কেউই এগিয়ে আসেনি।

আরব বিশ্বের বড় শক্তির মধ্যে একমাত্র তুরস্ক ছিল, যার কূটনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা ছিল উচ্চতর। তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের ‘উম্মাহ’র দাবি করেছিল, তবে গাজার দুঃখ-দুর্দশা দেখেও তারা তেমন কোনও পদক্ষেপ নিল না। কোনও রসদ, সামরিক সহযোগিতা কিংবা কূটনৈতিক সহায়তা কেউ তাদের দিক থেকে আসেনি। এ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, গাজার জন্য কোনও ধরনের সুরক্ষা বা সহানুভূতি কখনো তাদের শীর্ষ অগ্রাধিকার ছিল না।

বিশ্ব মুসলিমদের একটি বৃহত্তর সেনাবাহিনী ছিল—৫০ লাখ সৈন্য, যুদ্ধবিমান, ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র, গোয়েন্দা বাহিনী, স্যাটেলাইট, আধুনিক প্রযুক্তি, এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র। এই শক্তির পরিপ্রেক্ষিতে, গাজার আকাশে কেন একটিও বিমান দেখা গেল না? কেন গাজার আকাশে একটিও ছায়া পড়েনি? গাজার দিকে কেউ হাঁটেনি?

এবং সবশেষে, এটি নিছক একটি সন্ত্রস্ত অবস্থা, যেখানে নিরবতা ছিল সবচেয়ে বড় অস্বীকৃতি। মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো সব কিছু জানত, কিন্তু কিছুই করেনি। গাজার অবস্থা এক মহা সংকট, আর তাতে সবাই চুপ ছিল। কেবল পাকিস্তান, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মিশর, তুরস্কের মতো দেশগুলোর নীরবতা ইতিহাসে এমন এক করুণ অধ্যায় হিসেবে লেখা থাকবে, যেখানে মুসলিম বিশ্ব প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেনি, দাঁড়ানোর সংকল্পও করেনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও কি মুসলিম বিশ্বের শিক্ষা ছিল না?

এটি মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসের এক বিরাট বিপর্যয়ের অংশ হিসেবে লেখা থাকবে, যা প্রতিটি মুসলমানের জন্য এক অনুতাপের স্থান হয়ে দাঁড়াবে। বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে, যখন জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মহল কিছু নীতি ও সংস্থা স্থাপন করেছিল, তখনেও মুসলিম বিশ্ব ঠিক একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাল। বিশ্বযুদ্ধের শেষে আরব এবং মুসলিম রাষ্ট্রগুলো যে ঐক্য, সহানুভূতি, এবং মিলিত প্রচেষ্টার জন্য প্রস্তুত হতে পারবে, তা কখনও নিশ্চিত ছিল না।

যতদিন গাজার মতো অন্যায়-অত্যাচার চলে, যতদিন রোহিঙ্গা, কাশ্মীর, উইঘুর কিংবা ইয়েমেনের সাধারণ মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়, মুসলিম বিশ্বের ঐক্যহীনতা এবং কার্যকর পদক্ষেপের অভাব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সহানুভূতির বদলে আত্মকেন্দ্রিকতা এবং দলে দলে ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণই প্রাধান্য পেয়ে গেছে। কোথাও দেখা যায় না সেই একতাবদ্ধ সমাজ, যা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।

গাজার বিপর্যয়ের পাঠ: ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, গাজার এই বিপর্যয়ের পর মুসলিম বিশ্ব কি শিক্ষা গ্রহণ করবে? যে সমাজ এত শক্তিশালী, প্রযুক্তিতে উন্নত, সম্পদে পূর্ণ, তার জন্য কি এরকম সহানুভূতির অভাব সত্যিই মেনে নেওয়া সম্ভব? কিভাবে তারা তাদের শক্তির সঠিক ব্যবহার করবে, যাতে ভবিষ্যতে গাজার মতো কোন মানবিক বিপর্যয় কোনো রাষ্ট্রের জনগণের প্রতি হওয়া না পারে? যদি সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া যেতো, তবে আজকের এই অবস্থা ঘটতো কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।

আজ যখন গাজার প্রতি সমর্থন জানানো হয়, তখন প্রতিটি শব্দের ভেতর সেই নীরবতা, সেই অক্ষমতা প্রতিধ্বনিত হয়। মুসলিম বিশ্বের আরেকটি বিপর্যয়ের ইতিহাস হয়ে দাঁড়ায় এই মুহূর্ত, যে মুহূর্তে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তা আর ঘটেনি।

এবং গাজার এই দুঃখজনক দৃশ্য পরবর্তীতে মুসলিম জাতির জন্য শুধুমাত্র একটি প্রশ্নই রেখে যাবে—‘এখনো কি আমরা একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর সক্ষমতা তৈরি করতে পারব?’

ট্যাগ
পোস্টকারীর সকল তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

বিয়ে করেছেন অভিনেতা জামিল হোসেন এবং মুনমুন আহমেদ মুন ।

গাজার বেদনাদায়ক নীরবতা: মুসলিম বিশ্বের অব্যক্ত ব্যর্থতা।

প্রকাশিত হয়েছে: ০৩:৩৩:০৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৬ এপ্রিল ২০২৫

বিশ্ব ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে গাজা অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতি। একটি মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিফলন যেখানে, মুসলিম বিশ্বের শক্তি ও ক্ষমতা একদিকে ছিল, কিন্তু গাজার রক্ষার্থে কোনও কার্যকর পদক্ষেপই দেখা যায়নি।

পাকিস্তান, যেটি বিশ্বের অন্যতম পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, তবুও গাজার ওপর হামলা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটিও পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করা হয়নি। এটি কি কেবল অস্ত্রের মহাকাব্যিক শক্তির প্রতি বিশ্বাস ছিল, নাকি আসল চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে অপর্যাপ্ত সাহস? ইতিহাসের পাতা গুলো কি শুধু ক্ষমতার দম্ভ ও প্রকৃত সহানুভূতির অভাবের সাক্ষী হয়ে থাকবে?

এদিকে, মিশর যা হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়ে নীলনদের তীরে দাঁড়িয়ে, সেই দেশও কোনও কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি। যখন গাজার শিশুরা তৃষ্ণায় কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল, তখন মিশরের সমুদ্রতীরের এক প্রান্তে বিশাল বিলাসবহুল সসানদের রাজত্ব চলছিল। নীলনদের প্রবাহ কখনও গাজার শুকনো মাটিতে পৌঁছায়নি, আর গাজার জন্য সহানুভূতি আসেনি।

তেলের সাগরের রাজ্য সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতও নিরব ছিল। সেই অঞ্চলের আর্থিক সম্ভাবনা বিশাল, তবে গাজার জন্য তারা কিছুই করেনি। গাজার অ্যাম্বুলেন্সগুলো পেট্রোলের অভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল নিরুপায়। এমন একটি দৃশ্য, যেখানে সহানুভূতির পরিবর্তে সম্পদ আর শক্তির আধিক্য ছিল, কিন্তু কেউই এগিয়ে আসেনি।

আরব বিশ্বের বড় শক্তির মধ্যে একমাত্র তুরস্ক ছিল, যার কূটনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা ছিল উচ্চতর। তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের ‘উম্মাহ’র দাবি করেছিল, তবে গাজার দুঃখ-দুর্দশা দেখেও তারা তেমন কোনও পদক্ষেপ নিল না। কোনও রসদ, সামরিক সহযোগিতা কিংবা কূটনৈতিক সহায়তা কেউ তাদের দিক থেকে আসেনি। এ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, গাজার জন্য কোনও ধরনের সুরক্ষা বা সহানুভূতি কখনো তাদের শীর্ষ অগ্রাধিকার ছিল না।

বিশ্ব মুসলিমদের একটি বৃহত্তর সেনাবাহিনী ছিল—৫০ লাখ সৈন্য, যুদ্ধবিমান, ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র, গোয়েন্দা বাহিনী, স্যাটেলাইট, আধুনিক প্রযুক্তি, এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র। এই শক্তির পরিপ্রেক্ষিতে, গাজার আকাশে কেন একটিও বিমান দেখা গেল না? কেন গাজার আকাশে একটিও ছায়া পড়েনি? গাজার দিকে কেউ হাঁটেনি?

এবং সবশেষে, এটি নিছক একটি সন্ত্রস্ত অবস্থা, যেখানে নিরবতা ছিল সবচেয়ে বড় অস্বীকৃতি। মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো সব কিছু জানত, কিন্তু কিছুই করেনি। গাজার অবস্থা এক মহা সংকট, আর তাতে সবাই চুপ ছিল। কেবল পাকিস্তান, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মিশর, তুরস্কের মতো দেশগুলোর নীরবতা ইতিহাসে এমন এক করুণ অধ্যায় হিসেবে লেখা থাকবে, যেখানে মুসলিম বিশ্ব প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেনি, দাঁড়ানোর সংকল্পও করেনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও কি মুসলিম বিশ্বের শিক্ষা ছিল না?

এটি মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসের এক বিরাট বিপর্যয়ের অংশ হিসেবে লেখা থাকবে, যা প্রতিটি মুসলমানের জন্য এক অনুতাপের স্থান হয়ে দাঁড়াবে। বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে, যখন জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মহল কিছু নীতি ও সংস্থা স্থাপন করেছিল, তখনেও মুসলিম বিশ্ব ঠিক একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাল। বিশ্বযুদ্ধের শেষে আরব এবং মুসলিম রাষ্ট্রগুলো যে ঐক্য, সহানুভূতি, এবং মিলিত প্রচেষ্টার জন্য প্রস্তুত হতে পারবে, তা কখনও নিশ্চিত ছিল না।

যতদিন গাজার মতো অন্যায়-অত্যাচার চলে, যতদিন রোহিঙ্গা, কাশ্মীর, উইঘুর কিংবা ইয়েমেনের সাধারণ মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়, মুসলিম বিশ্বের ঐক্যহীনতা এবং কার্যকর পদক্ষেপের অভাব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সহানুভূতির বদলে আত্মকেন্দ্রিকতা এবং দলে দলে ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণই প্রাধান্য পেয়ে গেছে। কোথাও দেখা যায় না সেই একতাবদ্ধ সমাজ, যা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।

গাজার বিপর্যয়ের পাঠ: ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, গাজার এই বিপর্যয়ের পর মুসলিম বিশ্ব কি শিক্ষা গ্রহণ করবে? যে সমাজ এত শক্তিশালী, প্রযুক্তিতে উন্নত, সম্পদে পূর্ণ, তার জন্য কি এরকম সহানুভূতির অভাব সত্যিই মেনে নেওয়া সম্ভব? কিভাবে তারা তাদের শক্তির সঠিক ব্যবহার করবে, যাতে ভবিষ্যতে গাজার মতো কোন মানবিক বিপর্যয় কোনো রাষ্ট্রের জনগণের প্রতি হওয়া না পারে? যদি সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া যেতো, তবে আজকের এই অবস্থা ঘটতো কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।

আজ যখন গাজার প্রতি সমর্থন জানানো হয়, তখন প্রতিটি শব্দের ভেতর সেই নীরবতা, সেই অক্ষমতা প্রতিধ্বনিত হয়। মুসলিম বিশ্বের আরেকটি বিপর্যয়ের ইতিহাস হয়ে দাঁড়ায় এই মুহূর্ত, যে মুহূর্তে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তা আর ঘটেনি।

এবং গাজার এই দুঃখজনক দৃশ্য পরবর্তীতে মুসলিম জাতির জন্য শুধুমাত্র একটি প্রশ্নই রেখে যাবে—‘এখনো কি আমরা একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর সক্ষমতা তৈরি করতে পারব?’