
চারপাশে যখন চৈত্রের রোদ আর বসন্তের শেষ সুর, তখন পাহাড়জুড়ে শুরু হয় আনন্দ, উৎসব আর সংস্কৃতির মিলনমেলা। বছরের অন্যতম বর্ণাঢ্য আয়োজন পাহাড়ে বর্ষবরণ। এই উৎসব শুধু সময়ের পরিবর্তন নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক, আধ্যাত্মিক বিশ্বাস এবং হাজার বছরের লোকজ ঐতিহ্যের প্রতিফলন।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনধারা প্রকৃতির ছন্দে বাঁধা। বছরের শেষ দিকে জুমচাষ শেষ হয়, নতুন ফসলের প্রস্তুতি শুরু হয়। এই প্রাকৃতিক পর্যায়কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে পাহাড়ি নববর্ষের ধারণা। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে তাই উদযাপিত হয় বৈসাবি—যা আসলে তিনটি উৎসবের সম্মিলন:
বৈসু (ত্রিপুরা) বিজু (চাকমা) সাংগ্রাই (মারমা)
এই তিন জনগোষ্ঠী ছাড়াও তঞ্চঙ্গ্যা ও অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীরাও একই সময়ে পালন করে ফুলপূজা ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। বর্ষবরণ ঘিরে উৎসব চলে তিন দিন ধরে।
প্রথম দিন ফুল দিয়ে নদীতে পূজা (ফুলবিজু) দ্বিতীয় দিন পরিবার-পরিজন ও অতিথিদের নিয়ে মূল উৎসব তৃতীয় দিন জল খেলা ও প্রার্থনার মধ্য দিয়ে বছরের শেষকথা
মারমা সম্প্রদায়ের ‘সাংগ্রাই’ উৎসবে জল খেলা একটি প্রধান আকর্ষণ, যা কেবল আনন্দ নয়, বরং পবিত্রতার প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত। ত্রিপুরাদের ‘বৈসু’ উৎসবে রান্না হয় ‘পাচন’—১০-১২ রকমের সবজি মিশিয়ে তৈরি এক ঐতিহ্যবাহী পদ।
অনেক পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, পুরনো বছরের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট, রোগ-ব্যাধি, অশুভ শক্তি—সব কিছু দূর করতে হয় বছরের শেষে। তাই ফুল, ধূপ, জল দিয়ে প্রকৃতিকে শান্ত করার রীতি চালু রয়েছে। বর্ষবরণ তাই একটি আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির প্রক্রিয়া হিসেবেও বিবেচিত।
এই পাহাড়ি বর্ষবরণের সঙ্গে রয়েছে আন্তর্জাতিক মিলও। থাইল্যান্ডের সংক্রান উৎসব, মিয়ানমারের থিংজান, লাওসের পি মাই, কম্বোডিয়ার চোল চানাম থমে—
সব জায়গাতেই একই সময় জল খেলার মাধ্যমে বর্ষবরণ হয়। এই মিলগুলোর কারণে গবেষকেরা মনে করেন, পাহাড়ি বর্ষবরণের শিকড় রয়েছে প্রাচীন দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সংস্কৃতি ও বৌদ্ধ ঐতিহ্যের গভীরে।
বর্ষবরণ কেবল একটি ক্যালেন্ডার বদলের দিন নয়। এটা সম্পর্কের পুনর্নির্মাণ, সমাজের ঐক্য এবং আত্মশুদ্ধির সময়। পরিবার, সমাজ এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, বন্ধন এবং শুভ কামনা বিনিময়ের এক অনন্য উপলক্ষ।