০৪:১১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শহরে থাকি, কিন্তু মন পড়ে থাকে গ্রামে ভালো মন্দের মাঝে এক জীবনের গল্প

আমি, আমরা—গ্রামে জন্মানো, গ্রামে বড় হওয়া মানুষ। আমাদের শৈশবের সেই ছোট্ট গ্রামটি যেন ছিল বড় বড় ভালো মানুষের কোলাজে গড়া। তারা আমাদের শুধু ভালো হতে বলতেন না, কেন ভালো হওয়া উচিত—তাও বুঝিয়ে দিতেন। গ্রামে মন্দ ছিল, কিন্তু সেই মন্দে টানতো না। আনন্দ, প্রেম, ভালোবাসা, সুখ আর শান্তির আলোয় বড় হয়েছিলাম আমরা।

আমরা চোর-পুলিশ খেলেছি। কিন্তু খেলাতেও কেউ চোর হতে চাইত না। কেউ যদি লুডুতে একটু চুরি করে জিতে যেত, রাতে তার ঘুম আসতো না—অপরাধবোধে চোখে জল আসত। এই ছিল আমাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ।

আমাদের বড় হওয়ার দিনগুলো ঘিরে ছিল ঈদের খুশি, পূজার বাদ্য, মাহফিলের গজল, মসজিদের আজান আর মন্দিরের খোল করতালের মধুর ধ্বনি। পশ্চিম পাশে ছিল শ্মশান, মসজিদ আর কালীমন্দির ছিল এক দেয়ালের দুই পাশে, মাঝখানে কবরস্থান। বাজার তার পাশেই, আর বাজারের পাশ দিয়ে নদী বয়ে গেছে পশ্চিমে। গ্রামের পেছনে ছিল এক বিশাল বটগাছ—যেটা সারা বছর পাখিদের কিচিরমিচিরে মুখর থাকত।

বাস এসে থামতো বাড়ির সামনে। সেই কারণেই চায়ের দোকান ছিল গিজগিজ করে। ভোর থেকে টুংটাং করে চামচের শব্দ বেজে যেত। রাজ্জাক মিস্ত্রির মাইকে ‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা’ গান বাজলে, মানুষ চায়ের কাপে চুমুক দিতে ভুলে যেত। কেউ কেউ ড্রাইভারকে বলত, “গানডা শেষ হলেই স্টার্ট দিয়েন ড্রাইভার সায়েব।”

রেডিওতে নাটক শুনে মানুষ কাঁদত। আমরা গামলায় মুড়ি মেখে ছাদে উঠে অনুরোধের আসর শুনতাম। সেই ছাদে ওঠার সিঁড়ি ছিল না, ছিল একখানা মোটা মই। আম্মা জায়নামাজ হাতে নিয়ে ছাদে উঠতেন, মাগরিবের নামাজ পড়ে নামতেন।

পাকিস্তান আমলে জন্ম। তখন আম্মাকে ডাকতাম আম্মাজান, আব্বাকে আব্বাজান। তারা নামাজ-রোজার মানুষ ছিলেন। ক্লাস সেভেনে স্কুলে নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করেছিলাম—খবর শুনে খুশি হয়েছিলেন তাঁরা।

আমার যখন আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে হলো, আম্মাজান খুব খুশি হয়েছিলেন—সন্তান সুন্দর কিছু শিখতে চায়। আব্বাজান একটু চিন্তিত ছিলেন—ছবি আঁকা মানুষের ভবিষ্যৎ কি খুব মজবুত হয়? কিন্তু ভর্তি হলাম। তারপর সময় এল স্বাধীনতার আন্দোলনের, মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হলো।

আমার ভালো আঁকার কথা, মঞ্চে ভালো অভিনয়ের খবর তাঁদের কাছে পৌঁছালেও তাঁরা উদ্বিগ্ন হননি। বলতেন—সন্তান ভালো, গৌরব করার মতো কিছু করছে—এটাই অনেক।

সময়ের স্রোতে আমরা ‘আম্মাজান’-‘আব্বাজান’ থেকে ‘আম্মা’-‘আব্বা’ হলাম। আমাদের সন্তানেরা আজ আমাদের বাবা-মা ডাকে। সময় বদলায়, শব্দ বদলায়, সম্পর্কের প্রকাশ বদলায়। এখন চারপাশে অনেক ভালো আছে, আবার অনেক মন্দও। তবে আমরা আমাদের সন্তানদের খুব একটা বোঝাই না—ওটা ভালো, এটা মন্দ। তারা নিজেদের মতো বুঝে নিচ্ছে—এতেই আমাদের তৃপ্তি।

তবে বেদনার জায়গা একটাই—আমরা ওদের নিয়ে যাই গ্রামে, গল্প করি পুরনো দিনের, কিন্তু সেই গল্পের গ্রামটা দেখাতে পারি না। সেই শব্দ, বর্ণ, গন্ধ—যার মধ্যে আমরা বড় হয়েছি—তা ওদের গায়ে মাখাতে পারি না।

আমরা এখন শহরেই বাস করি। এই শহরকেই আমাদের ভাষায় বর্ণনা করি—ওরা শুনে, নিজেদের দেখা শহরের সাথে মেলাতে চায়। আমরা ভালো বদলে নতুন ভালো তৈরি করার স্বপ্ন দেখতাম। কে জানে কতটা লাভ বা লোকসান হয়েছে সেই স্বপ্নে?

তবু স্বপ্ন দেখি, আশা রাখি—এই নববর্ষে, বাংলা নতুন বছরে সবার জন্য রইল শুভকামনা।

 আফজাল হোসেন  শৈশবের স্মৃতিচারনে  ফেসবুক থেকে নেওয়া ।

ট্যাগ
পোস্টকারীর সকল তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

শহরে থাকি, কিন্তু মন পড়ে থাকে গ্রামে ভালো মন্দের মাঝে এক জীবনের গল্প

প্রকাশিত হয়েছে: ০৬:১২:৩৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৫

আমি, আমরা—গ্রামে জন্মানো, গ্রামে বড় হওয়া মানুষ। আমাদের শৈশবের সেই ছোট্ট গ্রামটি যেন ছিল বড় বড় ভালো মানুষের কোলাজে গড়া। তারা আমাদের শুধু ভালো হতে বলতেন না, কেন ভালো হওয়া উচিত—তাও বুঝিয়ে দিতেন। গ্রামে মন্দ ছিল, কিন্তু সেই মন্দে টানতো না। আনন্দ, প্রেম, ভালোবাসা, সুখ আর শান্তির আলোয় বড় হয়েছিলাম আমরা।

আমরা চোর-পুলিশ খেলেছি। কিন্তু খেলাতেও কেউ চোর হতে চাইত না। কেউ যদি লুডুতে একটু চুরি করে জিতে যেত, রাতে তার ঘুম আসতো না—অপরাধবোধে চোখে জল আসত। এই ছিল আমাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ।

আমাদের বড় হওয়ার দিনগুলো ঘিরে ছিল ঈদের খুশি, পূজার বাদ্য, মাহফিলের গজল, মসজিদের আজান আর মন্দিরের খোল করতালের মধুর ধ্বনি। পশ্চিম পাশে ছিল শ্মশান, মসজিদ আর কালীমন্দির ছিল এক দেয়ালের দুই পাশে, মাঝখানে কবরস্থান। বাজার তার পাশেই, আর বাজারের পাশ দিয়ে নদী বয়ে গেছে পশ্চিমে। গ্রামের পেছনে ছিল এক বিশাল বটগাছ—যেটা সারা বছর পাখিদের কিচিরমিচিরে মুখর থাকত।

বাস এসে থামতো বাড়ির সামনে। সেই কারণেই চায়ের দোকান ছিল গিজগিজ করে। ভোর থেকে টুংটাং করে চামচের শব্দ বেজে যেত। রাজ্জাক মিস্ত্রির মাইকে ‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা’ গান বাজলে, মানুষ চায়ের কাপে চুমুক দিতে ভুলে যেত। কেউ কেউ ড্রাইভারকে বলত, “গানডা শেষ হলেই স্টার্ট দিয়েন ড্রাইভার সায়েব।”

রেডিওতে নাটক শুনে মানুষ কাঁদত। আমরা গামলায় মুড়ি মেখে ছাদে উঠে অনুরোধের আসর শুনতাম। সেই ছাদে ওঠার সিঁড়ি ছিল না, ছিল একখানা মোটা মই। আম্মা জায়নামাজ হাতে নিয়ে ছাদে উঠতেন, মাগরিবের নামাজ পড়ে নামতেন।

পাকিস্তান আমলে জন্ম। তখন আম্মাকে ডাকতাম আম্মাজান, আব্বাকে আব্বাজান। তারা নামাজ-রোজার মানুষ ছিলেন। ক্লাস সেভেনে স্কুলে নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করেছিলাম—খবর শুনে খুশি হয়েছিলেন তাঁরা।

আমার যখন আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে হলো, আম্মাজান খুব খুশি হয়েছিলেন—সন্তান সুন্দর কিছু শিখতে চায়। আব্বাজান একটু চিন্তিত ছিলেন—ছবি আঁকা মানুষের ভবিষ্যৎ কি খুব মজবুত হয়? কিন্তু ভর্তি হলাম। তারপর সময় এল স্বাধীনতার আন্দোলনের, মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হলো।

আমার ভালো আঁকার কথা, মঞ্চে ভালো অভিনয়ের খবর তাঁদের কাছে পৌঁছালেও তাঁরা উদ্বিগ্ন হননি। বলতেন—সন্তান ভালো, গৌরব করার মতো কিছু করছে—এটাই অনেক।

সময়ের স্রোতে আমরা ‘আম্মাজান’-‘আব্বাজান’ থেকে ‘আম্মা’-‘আব্বা’ হলাম। আমাদের সন্তানেরা আজ আমাদের বাবা-মা ডাকে। সময় বদলায়, শব্দ বদলায়, সম্পর্কের প্রকাশ বদলায়। এখন চারপাশে অনেক ভালো আছে, আবার অনেক মন্দও। তবে আমরা আমাদের সন্তানদের খুব একটা বোঝাই না—ওটা ভালো, এটা মন্দ। তারা নিজেদের মতো বুঝে নিচ্ছে—এতেই আমাদের তৃপ্তি।

তবে বেদনার জায়গা একটাই—আমরা ওদের নিয়ে যাই গ্রামে, গল্প করি পুরনো দিনের, কিন্তু সেই গল্পের গ্রামটা দেখাতে পারি না। সেই শব্দ, বর্ণ, গন্ধ—যার মধ্যে আমরা বড় হয়েছি—তা ওদের গায়ে মাখাতে পারি না।

আমরা এখন শহরেই বাস করি। এই শহরকেই আমাদের ভাষায় বর্ণনা করি—ওরা শুনে, নিজেদের দেখা শহরের সাথে মেলাতে চায়। আমরা ভালো বদলে নতুন ভালো তৈরি করার স্বপ্ন দেখতাম। কে জানে কতটা লাভ বা লোকসান হয়েছে সেই স্বপ্নে?

তবু স্বপ্ন দেখি, আশা রাখি—এই নববর্ষে, বাংলা নতুন বছরে সবার জন্য রইল শুভকামনা।

 আফজাল হোসেন  শৈশবের স্মৃতিচারনে  ফেসবুক থেকে নেওয়া ।