
✍ গল্প | শোক, অভিনয় আর এক নিঃশ্বাসের গল্প
রাত তখন প্রায় তিনটা।
চাঁদটা জানালার ফাঁক গলে ঘরের মেঝেতে সাদা আলো ছড়িয়ে দিয়েছে।
ঘরে নিস্তব্ধতা, যেন পৃথিবীও থমকে আছে।
সুদর্শনা চুপচাপ বসে আছে দুই সন্তানের পাশে।
তাদের ঘুমন্ত মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। মাথা নিচু করে বলে,
“তোমরা ভালো থাকো… যেখানে যাচ্ছো।”
তারপর…
আস্তে করে এগিয়ে যায় ছোট ছেলেটার দিকে।
তিন বছর বয়স। মুখে লেগে থাকা আধো হাসি এখনও নিস্পাপ।
সুদর্শনা তার গলায় হাত রাখে। ধীরে ধীরে চেপে ধরে।
ছেলেটা ছটফট করে, ঠোঁট কেঁপে ওঠে, কিন্তু কোনো শব্দ বের হয় না।
তারপর বড় মেয়েটার দিকে যায়।
মেয়েটা একটু বড়— পাঁচ বছর।
সে জেগে যায়, কিছু বোঝার আগেই তার মুখে চেপে ধরে বালিশ।
সেই রাতে ঘরে আর কোনো শব্দ ছিল না, শুধু একটা নিঃশব্দ কান্না—
যেটা হয়তো সুদর্শনার নিজের মধ্যেই কোথাও ছিল, অথবা একেবারেই ছিল না।
সকাল বেলা…
পাড়া কাঁপিয়ে ওঠে তার চিৎকারে।
“আমার বাচ্চাগুলারে কে মারল! ও আল্লাহ, আমি শেষ!”
চোখে পানি, গলায় কাঁপুনি, বুক চাপড়ে কান্না— যেন এক ভাঙাচোরা মায়ের সর্বনাশ।
পাড়ার মানুষ ছুটে আসে। কেউ পানি দেয়, কেউ ছেলেমেয়েদের গায়ে হাত বুলায়।
সবাই শোকাহত, কেউ ভাবেনি মায়ের চোখের কান্নাও অভিনয় হতে পারে।
কিন্তু সত্য বেশিদিন লুকিয়ে থাকে না।
পুলিশ আসে। শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ।
সুদর্শনার মুখের ভেতরের ভয় একসময় চোখে ধরা পড়ে।
তার চোখের পানি শুকিয়ে যায়, কণ্ঠ ভারী হয়, শরীর কেঁপে ওঠে।
একসময় ভেঙে পড়ে।
নিচু গলায় বলে—
“আমি… আমি নিজেই… ওদের মেরে ফেলছি।”
ঘর নিস্তব্ধ হয়ে যায় আবার, তবে এবার আর শান্তির নিস্তব্ধতা নয়—
এবার সেটা এক ভয়াবহ বাস্তবতার কফিন।
সেদিন থেকে সেই পাড়ায় আর কেউ চোখের পানি দেখলে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে না।
কারণ সবাই জানে— সব কান্না সত্যি হয় না।
কিছু কান্না হয় পর্দার, মুখোশের, আর মা হওয়ার অভিনয়ের।