বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গন এক রকম অভূতপূর্ব সময় পার করছে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর মাত্র আট মাসের ব্যবধানে অন্তত ২৬টি নতুন রাজনৈতিক দল ও প্ল্যাটফর্ম আত্মপ্রকাশ করেছে। এই প্রবণতা রাজনীতিতে বহুমাত্রিক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

নিউক্লিয়াস পার্টি, জনপ্রিয় পার্টি, জাগ্রত পার্টি, আমজনতার দল, আ-আম জনতা পার্টি—এমন অসংখ্য নাম এখন শোনা যাচ্ছে রাজনৈতিক ভাষ্য ও মিডিয়া জগতে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে নতুন দলের বন্যা প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক সুযোগ গ্রহণ, জোট রাজনীতিতে অংশ নেওয়া, ব্যক্তিগত স্বার্থ অর্জন এবং রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রয়োজন।

🔍 অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক উন্মেষ

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগে নতুন দল গঠনের হিড়িক শুরু হয়।
শুধু গত বছরেই গঠিত হয়েছে ১১টি নতুন দল, আর ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে এসেছে আরও ১১টি। সেই হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে তিনটি করে নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছে।

⚙️ রাজনীতি নাকি ক্ষমতার প্ল্যাটফর্ম?

নতুন দল গঠনের বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এগুলোর পেছনে আদর্শিক ভিত্তি কতটা দৃঢ়?

বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন,

“এখন একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে যে রাজনীতি করলে খুব দ্রুত লাভবান হওয়া যায়। রাজনীতি এখন অনেকের কাছে ব্যবসা আর ব্যক্তিগত প্রভাব খাটানোর প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে।”

🗣️ ‘রাজনৈতিক লেবেল’ না থাকায় কেউ জেলেও আটকে থাকেন!

ডেসটিনির আলোচিত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রফিকুল আমীন ‘বাংলাদেশ আ-আম জনতা পার্টি’ গঠন করেছেন ১২ বছর জেল খাটার পর। তার ভাষায়,

“আমি জেল সুপারকে বলেছি আমাকে কেন ছাড়া হচ্ছে না? তিনি বললেন—আপনার তো কোনো রাজনৈতিক দল নেই। যদি অন্তত হরকাতুল জিহাদ করতেন, তাহলে ছাড়তাম!”

তার মতে, রাজনৈতিক পরিচয় না থাকলে দেশে বিচার ও প্রশাসন থেকেও ন্যায্যতা মেলে না।

📉 জনগণের দৃষ্টিতে এই দলগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কোথায়?

সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী, পেশাজীবী কিংবা ভ্যানচালক—অধিকাংশই এই দলগুলোর নামও শোনেননি।
ঢাকার ভ্যানচালক হারুন বলেন,

“বাংলাদেশে মনে করেন ১০ জনেও দল করন যায়… এগিলার কোনো ইস্টিমেট আছে? আমরা ভ্যান গাড়িয়ালারাও বানাইতে পারি!”

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী সুপ্তি বলেন,

“স্টুডেন্টদের সংগঠন বাদে ওইভাবে কোনো কিছু দেখা হয়নি।”

🧩 রাজনৈতিক ব্যাঙের ছাতার মতো উত্থান

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন,

“নির্বাচনের গন্ধ এলেই হঠাৎ করে ব্যাঙের ছাতার মতো দল গজায়। এরশাদের সময়েও এমন হয়েছিল—১২০টা দল হয়েছিল, পরে জোট গঠন হয়েছিল ৯০টা দল নিয়ে। এগুলো আসলে সংখ্যার খেলা।”

✅ প্রাসঙ্গিকতা ও টিকে থাকার লড়াই

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, যত দলই আসুক—প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে হাতে গোনা কয়েকটি। বাকিরা এক সময় হারিয়ে যায় বা বড় দলের ছায়ায় বিলীন হয়।

তবে এনসিপি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, কিংবা ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ-এর মতো কিছু দল আদর্শিক ভিত্তিতে সংগঠিত হলেও বেশিরভাগই এখনো “রাজনৈতিক অর্থনীতি”র খেলায় ঘেরা।

📌 শেষ কথা:
গণতন্ত্রে বহুদলীয়তা জরুরি, তবে স্বার্থনির্ভর দলগুলোর বন্যা রাজনীতির ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে। এই দলগুলো কি আদর্শিক আন্দোলনের বাহক, না কি ক্ষমতা অর্জনের কৌশলী প্রকল্প—এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।