
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের বিকল্প যোগাযোগ স্থাপনে একটি কৌশলগত করিডোর নির্মাণ করছে দেশটি, যা বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে সমুদ্রপথে যুক্ত হবে আসাম ও মেঘালয়ের একটি উচ্চগতির মহাসড়কের সঙ্গে। ভারতের জাতীয় মহাসড়ক ও অবকাঠামো উন্নয়ন করপোরেশন (NHDICL) জানিয়েছে, শিলংয়ের মাওলিঙ্গখুং থেকে শিলচরের পাঁচগ্রাম পর্যন্ত ১৬৬.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই চার লেন মহাসড়কটি হবে “উত্তর-পূর্বের প্রথম হাই-স্পিড করিডোর।”
এই প্রকল্পকে ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির কেন্দ্রীয় অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এনএইচআইডিসিএলের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, “এটি কেবল একটি রাস্তা নয়; এটি একটি কৌশলগত মোড়, যা আমাদের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করবে।”
বাংলাদেশকে পাশ কাটিয়ে বিকল্প পথ
বর্তমানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের একমাত্র কার্যকর স্থলপথ হলো শিলিগুড়ি করিডোর বা “চিকেনস নেক”, যা ভৌগোলিকভাবে সংকীর্ণ এবং কৌশলগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। যদিও বাংলাদেশ হয়ে বিকল্প প্রবেশপথ রয়েছে, সেগুলো কার্যত নিষ্ক্রিয়। কারণ, বঙ্গোপসাগর এলাকায় ঢাকা তার একচ্ছত্র প্রভাব বজায় রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে ভারত এই করিডোরকে যুক্ত করছে মিয়ানমারের কালাদান মাল্টি-মডাল ট্রানজিট প্রকল্পের সঙ্গে, যার মাধ্যমে কলকাতা ও বিশাখাপত্তনম বন্দর থেকে জাহাজ আসবে মিয়ানমারের সিত্তে বন্দরে। সেখান থেকে কায়াকটু ও জোরিনপুই হয়ে মিজোরামের লংতলাই পৌঁছে তা সংযুক্ত হবে নতুন শিলং-শিলচর হাইওয়ের সঙ্গে।
কূটনৈতিক বার্তা ও প্রতিক্রিয়া
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, এই প্রকল্পের পেছনে একটি কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। মার্চে বেইজিংয়ে দেওয়া এক বক্তব্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “উত্তর-পূর্ব ভারত ভূমিবেষ্টিত অঞ্চল এবং এর জন্য একমাত্র সাগরদ্বার হচ্ছে ঢাকা।”
এই বক্তব্যের জবাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৪ এপ্রিল ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে ইউনূসের সঙ্গে এক বৈঠকে ‘উস্কানিমূলক মন্তব্য’ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান বলে সূত্র জানায়।
বিশাল বাজেট ও প্রকৌশল চ্যালেঞ্জ
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে গত ৩০ এপ্রিল ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ২২,৮৬৪ কোটি রুপি বাজেট অনুমোদন করেছে। এর মধ্যে ১৪৪.৮ কিমি পড়ছে মেঘালয়ে এবং ২২ কিমি আসামে। অঞ্চলটি দুর্গম হওয়ায় প্রকৌশলগতভাবে এটি হবে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং।
এনএইচআইডিসিএল জানিয়েছে, এখানে স্লোপ স্ট্যাবিলাইজেশন, ভূমিধস পূর্বাভাস সেন্সর এবং সর্বাধুনিক নির্মাণ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
ভবিষ্যৎ প্রভাব: কৌশল ও অর্থনীতি উভয়েই
এই করিডোর চালু হলে কলকাতা ও বিশাখাপত্তনম থেকে সরাসরি সমুদ্রপথে পণ্য এসে উত্তর-পূর্বে প্রবেশ করবে এবং সেখান থেকে স্থলপথে বিতরণ সহজ হবে। এতে বাংলাদেশের উপর ভারতের নির্ভরতা কমবে এবং উত্তর-পূর্বে অর্থনৈতিক তৎপরতা বহুগুণে বাড়বে।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এর বিশ্লেষণে বলা হয়, “এই প্রকল্প ভারতীয় ভূ-অর্থনীতি ও নিরাপত্তার এক যুগান্তকারী ধাপ।”