০৩:১৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

“দখলের ভেতরে প্রতিবাদ: ইসরায়েলের নিভৃত সাহসীদের কথা”

  • নাতাশা মুন্নি
  • প্রকাশিত হয়েছে: ১০:০৫:১৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫
  • ৮১ শেয়ার

ইসরায়েলের ভেতরের প্রতিবাদ: নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে কণ্ঠগুলো আমরা শুনি না

ইসরায়েল—একটি রাষ্ট্র, যার নাম উচ্চারণেই ভেসে আসে ফিলিস্তিনের ওপর দখল, বোমাবর্ষণ আর নির্মম হত্যাযজ্ঞের দৃশ্য। কিন্তু এই দখলদার রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরেও কিছু মানুষ, কিছু সংগঠন নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যুদ্ধ, বর্ণবাদ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে। কারা এঁরা? কেনই বা তাঁদের কথা বিশ্ব খুব কম জানে?

________________________________________

ভিন্নমতের আদিগণ: মেইর ভিলনার

ইসরায়েলি ইতিহাসে যুদ্ধ ও দখলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া মানুষের একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে। সেই ধারার একজন আদিগণ ছিলেন মেইর ভিলনার (১৯১৮–২০০৩)। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারী হয়েও তিনি ছিলেন জায়নিজম ও বর্ণবাদবিরোধী একজন দৃঢ় মার্ক্সবাদী।

পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে তিনি ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরোধিতা করেন। তাঁর অবস্থানের কারণে তাঁকে ‘দেশদ্রোহী’ বলা হয় এবং একবার এক উগ্রপন্থী ইহুদির ছুরিকাঘাতে আহত হন। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গঠিত হয় হাদাশ—একটি আরব-ইহুদি বামপন্থী দল, যা আজও সংসদে সক্রিয়।

________________________________________

ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া সাহসী সংগঠন

ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার আগেই বাম সংগঠন ‘মাপাম’, ‘মাকি’, ও ‘হাশোমের হাতসায়ার’ আরব-ইহুদি সহাবস্থানের পক্ষে ছিল। তারা বিশ্বাস করত, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছাড়া নিরাপত্তা অসম্ভব। ১৯৬৭-র পর ‘অধিকৃত ভূখণ্ড’ শব্দবন্ধটি জনপ্রিয় হয় মূলত ইসরায়েলি মানবাধিকার কর্মীদের মাধ্যমেই।

________________________________________

এখনো বেঁচে থাকা প্রতিবাদের ধারা

বর্তমানে ইসরায়েলের ভেতরেও সক্রিয় রয়েছে এক ঝাঁক সংগঠন, যারা নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরব। এর মধ্যে রয়েছে ‘বেতসেলেম’, ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’, ‘মখসোম ওয়াচ’, ‘যেশ গ্ভুল’, ‘জোচরট’ ইত্যাদি। সাবেক সেনা, নারী অধিকারকর্মী, শিক্ষক ও সাংবাদিকরা এই সংগঠনে যুক্ত। এদের মতে, ফিলিস্তিনে যা হচ্ছে তা স্পষ্টতই যুদ্ধাপরাধ।

________________________________________

প্রতিবাদ মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ?

এই সংগঠনগুলোকে ইসরায়েলি সরকার নানা উপায়ে দমন করে—আর্থিক নিপীড়ন, নজরদারি, সামাজিকভাবে একঘরে করে দেওয়া। ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’-এর মতো সংগঠনের ওপর চলছে লাগাতার হুমকি। ২০১৮ সালে পাস হওয়া বিতর্কিত ‘নেশন স্টেট ল’ ইহুদিদের একমাত্র রাষ্ট্রীয় জাতি হিসেবে ঘোষণা দেয়—যার বিরোধিতা করেন হাদাশ পার্টির এমপি আইমান ওদে, দোভ খানিন ও তামার জানবার্গ।

________________________________________

২০২৩-২৪-এর সাম্প্রতিক প্রতিবাদ

২০২৩ সালের গাজা আগ্রাসনের সময় তেল আবিব, হাইফা, ও নাজারেথে যুদ্ধবিরোধী মিছিল হয়। ‘জিউস এগেইনস্ট জেনোসাইড’, ‘স্টুডেন্টস ফর সিজফায়ার’সহ ছোট সংগঠনগুলো রাস্তায় নামলে পুলিশি নিপীড়নের মুখে পড়ে।

তবু গিডিওন লেভি, আমির হাসের মতো সাংবাদিকরা হারেৎজ পত্রিকায় সাহসের সঙ্গে লিখে চলেছেন। তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষক-ছাত্র গাজার সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বহিষ্কৃত হয়েছেন।

________________________________________

‘না’ বলার রাজনীতি

সেনাবাহিনী যোগদান বাধ্যতামূলক হলেও অনেক তরুণ-তরুণী এতে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এদের বলা হয় ‘রিফিউজেনিক্স’। তারা ‘মেসারভত’ নামের সংগঠনের মাধ্যমে সহায়তা পান। তাঁদের বুকে লেখা—“উর্দি পরা খুনি হতে অস্বীকার করি।”

________________________________________

নীরবতার কারণ: ভয়, শিক্ষা ও সমাজচ্যুতি

ইসরায়েলি পাঠ্যবইয়ে ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব নেই। প্রতিবাদ মানেই আত্মপরিচয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যার ফলে পরিবারে ফাটল, বন্ধুত্বে ছেদ এবং পেশাগতভাবে ধ্বংস হওয়া খুব সাধারণ ঘটনা।

________________________________________

কেন আমরা এদের কথা জানি না?

কারণ স্পষ্ট—রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এই মানবিক কণ্ঠগুলোকে সামনে আনতে চায় না। অথচ এসব কণ্ঠই ইসরায়েলের ভেতরে বেঁচে থাকা বিবেকের চিহ্ন।

________________________________________

ইসরায়েলি রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় চলা দখল ও নিপীড়নের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষগুলো প্রমাণ করে, বিবেক হারায়নি সব ইহুদি নাগরিক। যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই কণ্ঠগুলো শুধু ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়, বরং গোটা মানবতার জন্যই এক আশার প্রতীক।

ট্যাগ

“দখলের ভেতরে প্রতিবাদ: ইসরায়েলের নিভৃত সাহসীদের কথা”

প্রকাশিত হয়েছে: ১০:০৫:১৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫

ইসরায়েলের ভেতরের প্রতিবাদ: নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে কণ্ঠগুলো আমরা শুনি না

ইসরায়েল—একটি রাষ্ট্র, যার নাম উচ্চারণেই ভেসে আসে ফিলিস্তিনের ওপর দখল, বোমাবর্ষণ আর নির্মম হত্যাযজ্ঞের দৃশ্য। কিন্তু এই দখলদার রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরেও কিছু মানুষ, কিছু সংগঠন নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যুদ্ধ, বর্ণবাদ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে। কারা এঁরা? কেনই বা তাঁদের কথা বিশ্ব খুব কম জানে?

________________________________________

ভিন্নমতের আদিগণ: মেইর ভিলনার

ইসরায়েলি ইতিহাসে যুদ্ধ ও দখলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া মানুষের একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে। সেই ধারার একজন আদিগণ ছিলেন মেইর ভিলনার (১৯১৮–২০০৩)। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারী হয়েও তিনি ছিলেন জায়নিজম ও বর্ণবাদবিরোধী একজন দৃঢ় মার্ক্সবাদী।

পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে তিনি ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরোধিতা করেন। তাঁর অবস্থানের কারণে তাঁকে ‘দেশদ্রোহী’ বলা হয় এবং একবার এক উগ্রপন্থী ইহুদির ছুরিকাঘাতে আহত হন। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গঠিত হয় হাদাশ—একটি আরব-ইহুদি বামপন্থী দল, যা আজও সংসদে সক্রিয়।

________________________________________

ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া সাহসী সংগঠন

ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার আগেই বাম সংগঠন ‘মাপাম’, ‘মাকি’, ও ‘হাশোমের হাতসায়ার’ আরব-ইহুদি সহাবস্থানের পক্ষে ছিল। তারা বিশ্বাস করত, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছাড়া নিরাপত্তা অসম্ভব। ১৯৬৭-র পর ‘অধিকৃত ভূখণ্ড’ শব্দবন্ধটি জনপ্রিয় হয় মূলত ইসরায়েলি মানবাধিকার কর্মীদের মাধ্যমেই।

________________________________________

এখনো বেঁচে থাকা প্রতিবাদের ধারা

বর্তমানে ইসরায়েলের ভেতরেও সক্রিয় রয়েছে এক ঝাঁক সংগঠন, যারা নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরব। এর মধ্যে রয়েছে ‘বেতসেলেম’, ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’, ‘মখসোম ওয়াচ’, ‘যেশ গ্ভুল’, ‘জোচরট’ ইত্যাদি। সাবেক সেনা, নারী অধিকারকর্মী, শিক্ষক ও সাংবাদিকরা এই সংগঠনে যুক্ত। এদের মতে, ফিলিস্তিনে যা হচ্ছে তা স্পষ্টতই যুদ্ধাপরাধ।

________________________________________

প্রতিবাদ মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ?

এই সংগঠনগুলোকে ইসরায়েলি সরকার নানা উপায়ে দমন করে—আর্থিক নিপীড়ন, নজরদারি, সামাজিকভাবে একঘরে করে দেওয়া। ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’-এর মতো সংগঠনের ওপর চলছে লাগাতার হুমকি। ২০১৮ সালে পাস হওয়া বিতর্কিত ‘নেশন স্টেট ল’ ইহুদিদের একমাত্র রাষ্ট্রীয় জাতি হিসেবে ঘোষণা দেয়—যার বিরোধিতা করেন হাদাশ পার্টির এমপি আইমান ওদে, দোভ খানিন ও তামার জানবার্গ।

________________________________________

২০২৩-২৪-এর সাম্প্রতিক প্রতিবাদ

২০২৩ সালের গাজা আগ্রাসনের সময় তেল আবিব, হাইফা, ও নাজারেথে যুদ্ধবিরোধী মিছিল হয়। ‘জিউস এগেইনস্ট জেনোসাইড’, ‘স্টুডেন্টস ফর সিজফায়ার’সহ ছোট সংগঠনগুলো রাস্তায় নামলে পুলিশি নিপীড়নের মুখে পড়ে।

তবু গিডিওন লেভি, আমির হাসের মতো সাংবাদিকরা হারেৎজ পত্রিকায় সাহসের সঙ্গে লিখে চলেছেন। তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষক-ছাত্র গাজার সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বহিষ্কৃত হয়েছেন।

________________________________________

‘না’ বলার রাজনীতি

সেনাবাহিনী যোগদান বাধ্যতামূলক হলেও অনেক তরুণ-তরুণী এতে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এদের বলা হয় ‘রিফিউজেনিক্স’। তারা ‘মেসারভত’ নামের সংগঠনের মাধ্যমে সহায়তা পান। তাঁদের বুকে লেখা—“উর্দি পরা খুনি হতে অস্বীকার করি।”

________________________________________

নীরবতার কারণ: ভয়, শিক্ষা ও সমাজচ্যুতি

ইসরায়েলি পাঠ্যবইয়ে ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব নেই। প্রতিবাদ মানেই আত্মপরিচয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যার ফলে পরিবারে ফাটল, বন্ধুত্বে ছেদ এবং পেশাগতভাবে ধ্বংস হওয়া খুব সাধারণ ঘটনা।

________________________________________

কেন আমরা এদের কথা জানি না?

কারণ স্পষ্ট—রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এই মানবিক কণ্ঠগুলোকে সামনে আনতে চায় না। অথচ এসব কণ্ঠই ইসরায়েলের ভেতরে বেঁচে থাকা বিবেকের চিহ্ন।

________________________________________

ইসরায়েলি রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় চলা দখল ও নিপীড়নের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষগুলো প্রমাণ করে, বিবেক হারায়নি সব ইহুদি নাগরিক। যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই কণ্ঠগুলো শুধু ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়, বরং গোটা মানবতার জন্যই এক আশার প্রতীক।