
বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর অন্যতম কারণ তামাক। সরকার তামাক থেকে যে কর আদায় করে এর চেয়ে অনেক বেশি টাকা ব্যয় হয় তামাকজনিত ক্ষতি মোকাবেলায়।এরপরও কী এই অনাকাঙ্খতি মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক অফিসের বাংলাদেশ ফ্যাক্টশিট ২০১৮ এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। প্রতিদিনের হিসাবে মারা যান ৪৪২ জন মানুষ। পরবর্তী বছরগুলোতে এই সংখ্যা আরো বেড়েছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের এক গবেষণায় দেখা যায়, তামাকখাত থেকে সম্পূরক শুল্ক ও মূসক বাবাদ অর্জিত রাজস্ব থেকে সরকারের আয় হয় ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, তামাক ব্যবহারে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমান ছিলো ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ফলে, তামাক নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত অসংক্রামক রোগে মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনা এবং অর্থনৈতিক ক্ষতিসহ এসডিজির অন্যান্য লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।
তামাক মূলত হৃৎপিণ্ড, লিভার ও ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। ধূমপানের ফলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্যান্সার, এর ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়। তামাক উচ্চ রক্তচাপ ও প্রান্তীয় রক্তনালীর রোগ করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৩ সালের তথ্য বলছে,বিশ্বের ১৬২ টি দেশের মধ্যে কমদামি সিগারেট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১২১তম।এমনটি পার্শবর্তী দেশ ভারতের সবচেয়ে কম দামি সিগারেটের দাম বাংলাদেশের কমদামি সিগারেটের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি।
২০১৫ সালে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) গৃহীত হয়। যেখানে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত লক্ষ্য ‘৩এ’ অর্জনের জন্য ডব্লিওএইচও ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি)বাস্তবায়ন সরকারগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০৩ সালে এফসিটিসি স্বাক্ষর করে।তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু এবং অসুস্থতা শুধু এসডিজির তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রা সুস্বাস্থ্য অর্জনের ক্ষেত্রেই বাধা নয়, বরং অন্যান্য লক্ষ্য অর্জনেও বাধা হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারকারী পরিবারগুলোর মাসিক খরচের ৫ শতাংশ তামাক ব্যবহারে এবং ১০ শতাংশ তামাক ব্যবহারজনিত রোগের চিকিৎসায় ব্যয় হয়। তামাকের কারণে দরিদ্র মানুষ, আরও দরিদ্র হয়ে পড়ে, যা এসডিজির দারিদ্র্য নির্মূলসংক্রান্ত লক্ষ্যমাত্রা ১ অর্জনে বড় বাধা।
গবেষণা বলছে, দক্ষিণ এশিয়োরর দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের হার সবচেয়ে বেশি ৩৫.৩ শতাংশ যা ভারতে ২৮.৬ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ১৯,১ শতাংশ। বাংলাদেশ নিত্যপণ্যের চেয়েও তামাক জাতীয় পণ্য যেমন বিড়ি, সিগারেট এবং জর্দা, গুলের কম দাম এবং সহজলভ্য। ফলে এর ব্যবহার আশানুরুপভাবে কমছে না। তামাক ব্যবহার নৈতিক, আইনগত এবং পরিবেশর ক্ষতি কমছে না।
তামাক চাষে বছরে ব্যবহৃত হয় এক লাখ একরের বেশি জমি, যা দেশে খাদ্যনিরাপত্তা ও টেকসই কৃষির (লক্ষ্যমাত্রা-২) জন্য ক্রমশ হুমকি তৈরি করছে। তামাকপাতা পোড়াতে এবং প্রক্রিয়াজাত করতে উজাড় হচ্ছে দেশের ৩০ শতাংশ বন। বিড়ি এবং জর্দা-গুল তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে নারী ও শিশুশ্রম। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়া সিগারেটের অবশিষ্টাংশসহ পলিথিনের মোড়ক ও জর্দা-গুলে ব্যবহৃত প্লাস্টিক কৌটা প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ করছে। এভাবে তামাকের উৎপাদন এবং ব্যবহার টেকসই উন্নয়নের প্রায় সবকটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।
তামাক নিয়ন্ত্রণে যেসব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান কাজ করে তারা মনে তামাকের উপর কর বাড়িয়ে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
এক্ষেত্রে ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেটে সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যা ৪টি থেকে কমিয়ে ৩টি করার দাবি জানিয়েছে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স-আত্মা।সিগারেটে ৪টি মূল্যস্তর (নিম্ন, মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়াম) থাকায় তামাক কর ও মূল্য পদক্ষেপ সঠিকভাবে কাজ করে না। নিম্ন ও মধ্যম স্তরকে একত্রিত করে দাম বাড়ানো হলে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে এবং তরুণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী সিগারেট ব্যবহারে বিশেষভাবে নিরুত্সাহিত হবে।
বাংলাদেশে সিগারেট অত্যন্ত সস্তা ও সহজলভ্য। বাংলাদেশের সিগারেট কর কাঠামো অত্যন্ত জটিল, যা সিগারেটের ব্যবহার কমাতে যথেষ্ট কার্যকর নয়। বর্তমানে আমাদের দেশে চারটি (নিম্ন, মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়াম) মূল্যস্তর থাকায় তামাক কর ও মূল্য পদক্ষেপ সঠিকভাবে কাজ করছে না। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম স্তরের সিগারেটের দামের পার্থক্য খুব সামান্য হওয়ায় ভোক্তারা সহজেই এক স্তর থেকে অন্য স্তরে যেতে পারছে। তাই নিম্ন ও মধ্যম স্তরকে একত্রিত করে দাম বাড়ানো হলে তরুণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী সিগারেট ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হবে এবং সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে। আর সিগারেটের ব্যবহার ১৫.১% থেকে কমে ১৩.০৩% হবে বলে মনে করছে আত্মা ও প্রজ্ঞা।
তবে প্রতি বছর জাতীয় বাজেটের আগে সিগারেটের কর ও মূল্য বৃদ্ধি ঠেকাতে সংঘবদ্ধ প্রচারণা চালায় তামাক কোম্পানিগুলো। তাদের যুক্তি করারোপের মাধ্যমে সিগারেটের দাম বাড়ানো হলে চোরাচালান ও অবৈধ বাণিজ্য বাড়বে এবং সরকার বিপুল পরিমান রাজস্ব হারাবে।
তামাক নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে চিকিৎসক ও গবেষকদের কয়েকটি সংগঠন বেশ তৎপরও। প্ল্যাটফর্ম ডক্টরস ফাউন্ডেশনের ফারজানা রহমান মুন বলেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তামাক পণ্যের বিদ্যমান কর ব্যবস্থার সংস্কার করা হলে প্রায় ২৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত হবেন। পাশাপাশি প্রায় ৯ লাখ তরুণসহ প্রায় ১৭ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. শাফিউন নাহিন শিমুল বলেন, তামাকজাত পণ্যে সরকারের যে রাজস্ব আসে, তা তামাকজনিত রোগে স্বাস্থ্য ব্যয়ের মাত্র ৭৫ শতাংশ মেটাতে পারে। কার্যকর করারোপের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বিগত অর্থবছরের চেয়ে ৪৩ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। এই প্রতিরোধ্যযোগ্য মৃত্যু প্রতিরোধে তামাকের ব্যবহার হ্রাস করা প্রয়োজন। এজন্য তামাকপণ্যের ওপর কার্যকর করারোপ করে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নেওয়া জরুরি।