গুগল ডিপমাইন্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ডেমিস হাসাবিস সম্প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ভবিষ্যৎ প্রভাব এবং তরুণ প্রজন্মের করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। তার মতে, আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে এআই প্রযুক্তি চাকরির বাজারে এক আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসবে, যেখানে কিছু প্রচলিত চাকরি বিলুপ্ত হবে এবং সম্পূর্ণ নতুন ধরনের পেশার সুযোগ তৈরি হবে। এই প্রেক্ষাপটে তিনি কিশোর-কিশোরীদের এখন থেকেই এআই বিষয়ে জ্ঞানার্জন শুরু করার ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন।
হাসাবিস উল্লেখ করেন, প্রযুক্তি মানবজীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে বারবার। ইন্টারনেট যেমন ৮০ ও ৯০-এর দশকের মিলেনিয়াল প্রজন্মের জীবনধারা বদলে দিয়েছে, এবং স্মার্টফোন যেমন জেনারেশন জেড বা জেন-জি’র জীবনে এনেছে নতুনত্ব, ঠিক তেমনি আগামী প্রজন্ম—জেনারেশন আলফার জীবন ও ভবিষ্যৎ অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রিত হবে এআই দ্বারা। তিনি বলেন, “যারা এখন থেকেই এআই শিখবে, এর ব্যবহার বুঝবে এবং প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে, তারাই ভবিষ্যতের বিজয়ী হবে।”
২০২২ সালে ওপেনএআই-এর চ্যাটজিপিটি আত্মপ্রকাশের পর থেকেই বিশ্বব্যাপী এআই নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। সাধারণ চাকরিজীবী থেকে শুরু করে উদ্যোক্তা, সকলের মনেই প্রশ্ন—এআই কি তাদের কর্মসংস্থান কেড়ে নেবে? এই প্রসঙ্গে হাসাবিস স্পষ্টভাবে জানান, “হ্যাঁ, কিছু চাকরি হারিয়ে যাবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে কাজের সুযোগ কমে যাবে। বরং, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের পেশার উদ্ভব ঘটবে।” তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, একসময় যেমন সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার, ইউএক্স ডিজাইনার বা ক্লাউড ইঞ্জিনিয়ারের মতো পদের অস্তিত্ব ছিল না, তেমনি ভবিষ্যতেও এআই-কেন্দ্রিক বহু নতুন পেশা তৈরি হবে যা এখনও আমাদের অজানা।
এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং টিকে থাকতে হলে নতুন কিছু শেখার আগ্রহ, সৃজনশীলতা এবং দ্রুত মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার ওপর গুরুত্ব দেন ডিপমাইন্ড সিইও। তিনি শুধু সফটওয়্যার ব্যবহার শেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রযুক্তির কার্যপদ্ধতি বোঝার ওপর জোর দেন। “শুধু জানলেই হবে না যে গুগল কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, বুঝতে হবে গুগল কীভাবে কাজ করে,” বলেন হাসাবিস। একারণেই তিনি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (STEM) শিক্ষার পাশাপাশি শেখার আগ্রহ, মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, সৃজনশীলতা এবং বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাভাবনার মতো সফট স্কিল বা মানবিক গুণাবলি অর্জনের পরামর্শ দেন।
তার মতে, ভবিষ্যতের অনেক কাজ রোবট বা মেশিন করলেও, যে কাজগুলোতে মানবিক বুদ্ধিমত্তা ও গভীর চিন্তার প্রয়োজন, সেখানে মানুষের আধিপত্য বজায় থাকবে। তাই শিক্ষা, বুদ্ধি ও দক্ষতা দিয়ে মানুষকে মেশিনের চেয়ে স্বতন্ত্র অবস্থানে থাকতে হবে।
তরুণ শিক্ষার্থীদের প্রতি ডেমিস হাসাবিসের আহ্বান, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন যেন শুধু পাঠ্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। এই সময়েই নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার এবং ভুল থেকে শেখার অফুরন্ত সুযোগ রয়েছে। তিনি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্মে কাজ করা, এআই ল্যাবগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা, বিনামূল্যে অনলাইন কোর্স করা এবং বাস্তব সমস্যা সমাধানে নিজেদের জ্ঞান প্রয়োগের ওপর জোর দেন।
হাসাবিস মনে করেন, ভবিষ্যতে সফল হওয়ার জন্য শুধু প্রযুক্তিগত জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে প্রয়োজন নিজেকে পরিবর্তন করার মানসিকতা। “মানুষের শক্তি কেবল বুদ্ধিমত্তা নয়, বরং মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। এটাই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। তাই যে নিজেকে বদলাতে পারবে, সে-ই টিকে থাকবে,” বলেন তিনি।
সবশেষে তিনি যোগ করেন, “এআই কেবল ভবিষ্যৎ নয়, এটি এখনকার বাস্তবতা। এটি এখনই আমাদের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। এই সময়ে যার হাতে এআই জ্ঞান থাকবে, তার হাতেই থাকবে আগামী দিনের শক্তি।” ডেমিস হাসাবিসের এই বক্তব্য তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা—এআইকে ভয় না পেয়ে, বরং এর সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার এখনই সময়।
প্রকাশক ও সম্পাদক
© কপিরাইট সমাচার বিশ্ব ২০২৫ | আমাদের ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।