প্রতি বছর লাখ লাখ মুসলমান বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইসলাম ধর্মের অন্যতম স্তম্ভ হজ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের পবিত্র নগরী মক্কায় সমবেত হন। এটি ইসলামের পাঁচটি মূল ভিত্তির মধ্যে একটি, যা শারীরিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ।
আরবি বছরের শেষ মাস জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত হজের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। এই সময়ে হাজীদের একের পর এক ধারাবাহিকভাবে পালন করতে হয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় রীতি। এই রীতিগুলোর প্রতিটির পেছনেই রয়েছে গভীর অর্থ ও ইতিহাস, যার সূত্রপাত হয় প্রিয়নবী ইব্রাহীম (আঃ)-এর সময়কাল থেকে।
চলুন জেনে নিই হজের সময় পালন করা আটটি মূল রীতি ও সেগুলোর ঐতিহাসিক পটভূমি
হজের সূচনা হয় ইহরাম গ্রহণের মধ্য দিয়ে। এটি শুধু একটি পোশাকই নয়, বরং আত্মিক প্রস্তুতিরও এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ইহরাম গ্রহণের অর্থ হচ্ছে হজের নিয়ত করা এবং নির্দিষ্ট কিছু কার্যবিধি অনুসরণ করা।
পুরুষরা দুই টুকরো সাদা, সেলাইবিহীন কাপড় পরিধান করেন – যা কাফনের মতো দেখতে – যেন তারা আত্মিকভাবে প্রস্তুত হয়ে স্রষ্টার নিকট আত্মসমর্পণ করেন। নারীদের জন্য রয়েছে ঢিলেঢালা ও শালীন পোশাক পরার নির্দেশ।
এই রীতির সূচনা করেছিলেন নবী ইব্রাহীম (আঃ)। তিনি কাবা নির্মাণের পর আল্লাহর আদেশে হজ পালনের বিধান শুরু করেন, তখন থেকেই ইহরাম এবং অন্যান্য রীতিগুলোর প্রবর্তন হয়।
ইহরাম বাঁধার পর হাজীদের জন্য কিছু আচরণগত বিধিনিষেধ আরোপিত হয়, যেমন:
এসবের মাধ্যমে দুনিয়াবি ও বাহ্যিক বিষয় থেকে সম্পূর্ণ বিরত থেকে আত্মিক উন্নয়নের একটি সময় শুরু হয়। এটি ইব্রাহীম (আঃ) যুগ থেকেই চালু।
মক্কা পৌঁছানোর পর হাজীরা কাবা শরীফের চারপাশে সাতবার ঘড়ির উল্টো দিকে ঘোরেন – একে বলা হয় তাওয়াফ। এটি ইসলামের সর্বোচ্চ পবিত্র স্থানকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর দিকেই নিজেকে সমর্পণের প্রকাশ।
বিশ্বাস করা হয়, জান্নাতে ফেরেশতারা ‘বাইতুল মা’মুর’ নামক ঘরের চারপাশে প্রদক্ষিণ করেন। কাবা শরীফ তার প্রতিফলন। সেই ঐতিহ্যেই কাবার তাওয়াফ চালু হয়।
ইসলামপূর্ব যুগেও এই রীতি ছিল, তবে ইসলাম পূর্বকালে অনেকেই উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ করতো। ইসলাম এসে সেই প্রথা পরিহার করে ইব্রাহীমি পদ্ধতি পুনঃস্থাপন করে।
এই রীতিটি স্মরণ করায় এক মায়ের ত্যাগ ও দৃঢ়তার ইতিহাস। হজরত হাজেরা (আঃ) পুত্র ইসমাইল (আঃ)-কে নিয়ে যখন মক্কার নির্জন স্থানে অবস্থান করছিলেন, তখন পানির সন্ধানে তিনি সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে সাতবার দৌঁড়ান।
এই ঘটনাকে স্মরণ করে হাজীরা এই দুই পাহাড়ের মাঝে সাতবার দৌঁড়ে যান। পরে সেখানে আল্লাহর আদেশে বের হয় জমজম কূপ, যা আজও তৃষ্ণার্তদের পরিপূর্ণতা দেয়।
হজের দ্বিতীয় দিনে হাজীরা আরাফাত ময়দানে সারাদিন অবস্থান করেন ও প্রার্থনায় নিমগ্ন থাকেন। এটি হজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এই দিনটিকে অনেকেই হাশরের ময়দানের প্রতীক বলে থাকেন, যেখানে শেষ বিচারে সব মানুষ একত্র হবে। দিন শেষে হাজীরা মুজদালিফায় রাত কাটান খোলা আকাশের নিচে। এতে আত্মসমর্পণ, ধৈর্য ও আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতার শিক্ষা নিহিত।
মিনায় তিনটি নির্দিষ্ট স্থানে, প্রতীকী শয়তানের দেয়ালে সাতটি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করেন হাজীরা।
এই রীতির পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক ঘটনা – যখন শয়তান নবী ইব্রাহীম (আঃ)-কে তাঁর সন্তান ইসমাইলকে কোরবানি না করতে প্ররোচনা দেয়। তখন ইব্রাহীম (আঃ) তিনবার শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে তাড়িয়ে দেন। সেই স্মরণেই আজকের এই প্রতীকী কংকর নিক্ষেপ।
পাথর নিক্ষেপের পর হাজীরা পশু কোরবানি দেন – যেটি স্মরণ করিয়ে দেয় ইব্রাহীম (আঃ)-এর সেই পরীক্ষার কথা, যেখানে তিনি আল্লাহর আদেশে প্রিয়পুত্র ইসমাইলকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন।
শেষপর্যন্ত আল্লাহ খুশি হয়ে তার পরিবর্তে একটি পশু কোরবানি করতে বলেন। সেই স্মৃতিতেই ঈদুল আযহা ও হজের কোরবানির ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা পায়।
হজের একটি শেষধাপ হলো চুল কেটে ফেলা বা পুরো মাথা ন্যাড়া করা। এটি ইহরাম থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রতীক এবং আত্মশুদ্ধির বহিঃপ্রকাশ।
নারীদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ মাথা ন্যাড়া করতে হয় না, বরং সামান্য পরিমাণ চুল কাটলেই যথেষ্ট।
হজ শুধু কিছু ধর্মীয় রীতির সমষ্টি নয়, এটি একটি জীবন্ত ইতিহাস, আত্মনিয়ন্ত্রণের চর্চা এবং সর্বোপরি, আল্লাহর প্রতি একাগ্র আনুগত্য ও ভালবাসার গভীর প্রকাশ। প্রতিটি ধাপে ধাপে ইব্রাহীম (আঃ), হাজেরা (আঃ) এবং ইসমাইল (আঃ)-এর ত্যাগ, ধৈর্য ও ঈমানের অনুপ্রেরণা বর্তমান। এ কারণে হজ শুধু শারীরিক সাধনার মাধ্যম নয়, বরং এটি আত্মিক পুনর্জন্মের এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
প্রকাশক ও সম্পাদক
© কপিরাইট সমাচার বিশ্ব ২০২৫ | আমাদের ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।