০৯:৫৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

যুক্তরাজ্যে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে পারবে অন্তর্বর্তী সরকার?

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের চার দিনের যুক্তরাজ্য সফর দেশের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে এই সফরের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে প্রশ্ন রয়ে যায়—এই প্রচেষ্টা কতটা বাস্তবসম্মত এবং কার্যকর হতে পারে?

বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ মতে, বিগত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে বলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রকাশিত শ্বেতপত্রে দাবি করা হয়। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গেছে যুক্তরাজ্যে। কিন্তু এই অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে রয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ:

১. আইনি জটিলতা ও প্রমাণের ঘাটতি

যে অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে, তা কীভাবে, কার মাধ্যমে ও কোথায় বিনিয়োগ হয়েছে, তার নির্ভরযোগ্য ও আদালতে টেকসই প্রমাণ উপস্থাপন করাই সবচেয়ে কঠিন কাজ।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সঠিকভাবে বলেন, “যোগসূত্র প্রমাণ করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”

২. দীর্ঘসূত্রিতা

সাধারণত পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে ৫ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত সময় লাগে। আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়ায় ধীরগতি ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা এই দীর্ঘসূত্রিতার জন্য দায়ী।

৩. রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব?

অতীতে এ ধরনের উদ্যোগ রাজনৈতিক চাপ বা কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতার অভাবে ফলপ্রসূ হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কার্যকর প্রতিশ্রুতি দিলেও সময় ও চাপ ধরে রাখা হবে চ্যালেঞ্জ।

যুক্তরাজ্যের ভূমিকা ও অবস্থান

পাচারকৃত অর্থ ফেরতে ব্রিটেন কতটা আন্তরিক—তা নির্ভর করছে তাদের আইনি কাঠামো, তদন্তকারী সংস্থা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। ইতোমধ্যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ইউকে, স্পটলাইট অন করাপশনসহ তিনটি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যেন তারা অবিলম্বে পাচারকৃত অর্থ জব্দ করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়।

প্রকাশিত তথ্য:
দ্য অবজারভার ও টিআই-ইউকের যৌথ অনুসন্ধানে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠদের নামে ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে ৯০ মিলিয়ন পাউন্ড ইতোমধ্যেই এনসিএ (NCA) জব্দ করেছে।

এই তথ্যগুলো বাংলাদেশের পক্ষে একটি কূটনৈতিক ও নৈতিক সুবিধা তৈরি করতে পারে।

অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশল

এই মুহূর্তে অধ্যাপক ইউনূসের সফরসঙ্গী হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ও দুদক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মোমেন। তাদের উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয়—এই সফর শুধুই প্রতীকী নয়, বরং এটিকে একটি সক্রিয় কৌশলগত প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

দুদক ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (MLAR) পাঠিয়েছে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বিশ্লেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন, যুক্তরাজ্যে যে সমস্ত বিশেষায়িত কোম্পানি বিদেশি সরকারের অর্থ পুনরুদ্ধার করে, তাদের সহযোগিতাও নেওয়া যেতে পারে।

অন্তর্বর্তী সরকারের এই উদ্যোগ সাহসী এবং সময়োপযোগী হলেও তাৎক্ষণিকভাবে বড় ধরনের অর্থ ফেরত পাওয়া সম্ভব নয়। তবে এটি একটি মূল্যবান সূচনা—যদি এই প্রক্রিয়াটি পরবর্তী সরকার দ্বারা ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করা হয়।

এই উদ্যোগ সফল করতে হলে চাই—

রাজনৈতিক ঐক্যমত্য,

পেশাদার তদন্ত ও দলিলাদি প্রস্তুতকরণ,

আন্তর্জাতিক সংস্থার সমর্থন এবং

সময়োপযোগী কূটনৈতিক কৌশল।

সফলতা যদি আসে, তবে তা শুধু অর্থ ফেরতের নয়—বরং রাষ্ট্রীয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার এক নতুন দিগন্তের সূচনাও হবে।

ট্যাগ

শিক্ষা ভবনের সামনে সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

যুক্তরাজ্যে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে পারবে অন্তর্বর্তী সরকার?

প্রকাশিত হয়েছে: ১১:০৮:৪৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ জুন ২০২৫

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের চার দিনের যুক্তরাজ্য সফর দেশের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে এই সফরের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে প্রশ্ন রয়ে যায়—এই প্রচেষ্টা কতটা বাস্তবসম্মত এবং কার্যকর হতে পারে?

বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ মতে, বিগত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে বলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রকাশিত শ্বেতপত্রে দাবি করা হয়। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গেছে যুক্তরাজ্যে। কিন্তু এই অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে রয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ:

১. আইনি জটিলতা ও প্রমাণের ঘাটতি

যে অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে, তা কীভাবে, কার মাধ্যমে ও কোথায় বিনিয়োগ হয়েছে, তার নির্ভরযোগ্য ও আদালতে টেকসই প্রমাণ উপস্থাপন করাই সবচেয়ে কঠিন কাজ।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সঠিকভাবে বলেন, “যোগসূত্র প্রমাণ করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”

২. দীর্ঘসূত্রিতা

সাধারণত পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে ৫ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত সময় লাগে। আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়ায় ধীরগতি ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা এই দীর্ঘসূত্রিতার জন্য দায়ী।

৩. রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব?

অতীতে এ ধরনের উদ্যোগ রাজনৈতিক চাপ বা কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতার অভাবে ফলপ্রসূ হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কার্যকর প্রতিশ্রুতি দিলেও সময় ও চাপ ধরে রাখা হবে চ্যালেঞ্জ।

যুক্তরাজ্যের ভূমিকা ও অবস্থান

পাচারকৃত অর্থ ফেরতে ব্রিটেন কতটা আন্তরিক—তা নির্ভর করছে তাদের আইনি কাঠামো, তদন্তকারী সংস্থা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। ইতোমধ্যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ইউকে, স্পটলাইট অন করাপশনসহ তিনটি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যেন তারা অবিলম্বে পাচারকৃত অর্থ জব্দ করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়।

প্রকাশিত তথ্য:
দ্য অবজারভার ও টিআই-ইউকের যৌথ অনুসন্ধানে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠদের নামে ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে ৯০ মিলিয়ন পাউন্ড ইতোমধ্যেই এনসিএ (NCA) জব্দ করেছে।

এই তথ্যগুলো বাংলাদেশের পক্ষে একটি কূটনৈতিক ও নৈতিক সুবিধা তৈরি করতে পারে।

অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশল

এই মুহূর্তে অধ্যাপক ইউনূসের সফরসঙ্গী হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ও দুদক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মোমেন। তাদের উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয়—এই সফর শুধুই প্রতীকী নয়, বরং এটিকে একটি সক্রিয় কৌশলগত প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

দুদক ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (MLAR) পাঠিয়েছে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বিশ্লেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন, যুক্তরাজ্যে যে সমস্ত বিশেষায়িত কোম্পানি বিদেশি সরকারের অর্থ পুনরুদ্ধার করে, তাদের সহযোগিতাও নেওয়া যেতে পারে।

অন্তর্বর্তী সরকারের এই উদ্যোগ সাহসী এবং সময়োপযোগী হলেও তাৎক্ষণিকভাবে বড় ধরনের অর্থ ফেরত পাওয়া সম্ভব নয়। তবে এটি একটি মূল্যবান সূচনা—যদি এই প্রক্রিয়াটি পরবর্তী সরকার দ্বারা ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করা হয়।

এই উদ্যোগ সফল করতে হলে চাই—

রাজনৈতিক ঐক্যমত্য,

পেশাদার তদন্ত ও দলিলাদি প্রস্তুতকরণ,

আন্তর্জাতিক সংস্থার সমর্থন এবং

সময়োপযোগী কূটনৈতিক কৌশল।

সফলতা যদি আসে, তবে তা শুধু অর্থ ফেরতের নয়—বরং রাষ্ট্রীয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার এক নতুন দিগন্তের সূচনাও হবে।