
মধ্যপ্রাচ্য যেন আবারও দাঁড়িয়ে নতুন এক অস্থিরতার মোড়ে। একদিকে ইরান ছুড়ছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, অন্যদিকে ইসরায়েল পাল্টা জবাব দিচ্ছে ইরানের বুশেহরে। এই ভয়াবহ সংঘাতের মাঝে ফের জোরালো হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু—”ইরানকে এখনই থামানো না গেলে, খুব শিগগির—হয়তো কয়েক মাসের মধ্যেই—তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে ফেলতে পারে।”
নেতানিয়াহুর এ ধরনের হুঁশিয়ারি অবশ্য নতুন নয়। ১৯৯২ সাল থেকেই তিনি ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম নিয়ে ইসরায়েলি সংসদে, মার্কিন কংগ্রেসে ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে সরব। তিন দশক ধরে তাঁর কণ্ঠে বারবার শোনা গেছে ইরানের পরমাণু বোমা তৈরির আশঙ্কা।
১৯৯৬ সালে মার্কিন কংগ্রেসে ভাষণ দিয়ে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, “সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে!”—আর ২০১২ সালে জাতিসংঘে এক চোখে পড়া দৃশ্যে তিনি বোমার কার্টুন দেখিয়ে বলেছিলেন, “ইরান এখন শেষ ধাপে।”
ইরানের পারমাণবিক যাত্রা শুরু হয়েছিল বন্ধুত্বের হাত ধরেই—ষাটের দশকে, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায়। ১৯৬৭ সালে তেহরানে পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব বদলে দেয় পুরো দৃশ্যপট।
সেই থেকে শুরু শত্রুতা, সন্দেহ ও নিষেধাজ্ঞার রাজনীতি।
২০০২ সালে নির্বাসিত একটি ইরানি গোষ্ঠী ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রের তথ্য ফাঁস করলে বিশ্বের চোখ ফেরে তেহরানের দিকে। এরপর একের পর এক জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, যার প্রভাব পড়ে ইরানের অর্থনীতি ও জনগণের জীবনযাত্রায়।
২০১৫ সালে ওবামা প্রশাসনের নেতৃত্বে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক Joint Comprehensive Plan of Action (JCPOA)। ইরান তখন প্রতিশ্রুতি দেয় পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত রাখার, আর বিশ্বশক্তিগুলো তুলে নেয় নিষেধাজ্ঞা।
তবে ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে সরে আসে, এবং আবারও ইরানকে ঘিরে পারমাণবিক উত্তেজনা বাড়তে থাকে।
নেতানিয়াহু এখন বলছেন, “এটা এক বছরের মধ্যে হতে পারে, আবার কয়েক মাসের মধ্যেও। আমরা অপেক্ষা করতে পারি না।”
তাঁর মতে, ইরান ‘অস্ত্র বানানোর একেবারে কাছাকাছি।’
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও সমর্থন দিয়ে বলেন, “আমি মনে করি ইরান খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।”
বিশ্বের পরমাণু পর্যবেক্ষণ সংস্থা আইএইএ বারবার পর্যালোচনা করে বলেছে, এখনো পর্যন্ত ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছে—এমন প্রমাণ নেই।
তবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা এবং স্থাপনার বিস্তার দেখে পশ্চিমা বিশ্ব উদ্বিগ্ন।
ইরান-ইসরায়েলের এই টানাপোড়েন শুধু দুই দেশের ব্যাপার নয়। এর আঁচ লেগে যেতে পারে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে, এমনকি বিশ্ব জ্বালানি বাজারেও।
বিশ্লেষকদের মতে, “নেতানিয়াহুর হুঁশিয়ারি যদি সত্যিও হয়, তবুও যুদ্ধ নয়, বরং কূটনীতি হওয়া উচিত সমাধান।”
ইতিহাস জানে—ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে আলোচনা নতুন নয়। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, সংকট এখন চরমে। এখন দেখার বিষয়, পৃথিবী কি আরেকটি যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে, নাকি শেষমেশ কূটনীতির টেবিলই রক্ষা করবে এই ঝলসে ওঠা অঞ্চলকে।