পবিত্র আশুরা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক গভীর ভাবগম্ভীর ও তাৎপর্যময় দিন। হিজরি বছরের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। এই দিনটি শুধু কারবালার জন্য স্মরণীয় নয়, বরং ইসলামি ইতিহাসে এই দিনে বহু গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এই দিনে একদিকে যেমন তাঁর প্রিয় নবীদের বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন, অন্যদিকে অপরাধী জাতির উপর তাঁর শাস্তিও বাস্তবায়ন করেছেন। নিচে আশুরার দিনে সংঘটিত ১০টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হলো।

১. সৃষ্টির সূচনা ও কিয়ামতের পূর্ণতা

আল্লাহ তায়ালার অসীম কুদরতে আশুরার দিনেই সৃষ্টি জগতের সূচনা হয়। হাদীস ও বিভিন্ন ইসলামি ব্যাখ্যাতে বলা হয়েছে—এই দিনেই আল্লাহ তায়ালা আকাশ, পৃথিবী, পাহাড়, সমুদ্র, ফেরেশতা এবং প্রথম মানব আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। আরও বিশ্বাস করা হয় যে, এই দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে, অর্থাৎ সৃষ্টি ও ধ্বংস—উভয়ই এই মহিমান্বিত দিনের সঙ্গে জড়িত।

২. আদম (আ.)-এর পৃথিবীতে প্রেরণ ও ক্ষমা লাভ

হজরত আদম (আ.) জান্নাতে অবস্থানকালে শয়তানের প্ররোচনায় ভুল করে ফল খাওয়ার পর আল্লাহ তাঁকে পৃথিবীতে পাঠান। এই ঘটনাও ঘটেছিল আশুরার দিন। কিন্তু আদম (আ.) অনুতপ্ত হন, দীর্ঘ সময় আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। অবশেষে এই দিনেই আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন এবং তাঁকে ক্ষমা করে দেন। একই দিনে আদম ও হাওয়া (আ.)-এর আরাফার ময়দানে পৃথিবীতে পুনর্মিলন ঘটে।

৩. নূহ (আ.)-এর তুফান ও জাহাজের নোঙর

নূহ (আ.) আল্লাহর আদেশে বহু বছর ধরে তাঁর জাতিকে সতর্ক করেন, কিন্তু তারা তা অগ্রাহ্য করে। অবশেষে আল্লাহর পক্ষ থেকে ভয়াবহ প্লাবন (তুফান) এসে যায়। ঈমানদারদের নিয়ে নূহ (আ.) একটি জাহাজে আরোহন করেন। দীর্ঘ সময় ধরে ভেসে থাকার পর জাহাজটি মহররমের ১০ তারিখে একটি পাহাড়ে (জুদি পর্বতে) স্থির হয়। এই ঘটনাটি ছিল বিশ্বাসীদের জন্য মুক্তি ও কাফেরদের জন্য নিপাতের প্রতীক।

৪. ইবরাহিম (আ.)-এর অগ্নিপরীক্ষা

নমরুদের শাসনামলে হজরত ইবরাহিম (আ.) যখন একেশ্বরবাদের প্রচার করেন, তখন তাঁকে বিশাল অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়। আগুনের তাপ এতটাই বেশি ছিল যে মানুষ তাঁকে যন্ত্রের সাহায্যে ফেলে দেয়। কিন্তু আল্লাহর কুদরতে সেই অগ্নিকুণ্ডকে ঠান্ডা করে দেওয়া হয়, এবং আশুরার দিন ইবরাহিম (আ.) নিরাপদে সেখান থেকে বের হয়ে আসেন। এটি আল্লাহর অলৌকিক শক্তির অন্যতম স্পষ্ট উদাহরণ।

৫. আইয়ুব (আ.)-এর ধৈর্য ও রোগমুক্তি

আল্লাহর প্রিয় বান্দা হজরত আইয়ুব (আ.) ছিলেন ধৈর্যের এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত। তিনি ১৮ বছর কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। তাঁর দেহে পোকা পড়ে গিয়েছিল, পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তবু তিনি আল্লাহর উপর অগাধ আস্থা রাখেন। অবশেষে আশুরার দিন আল্লাহ তাঁকে সম্পূর্ণ সুস্থতা দান করেন এবং পূর্বের সমস্ত ধনসম্পদ ফিরিয়ে দেন। এই ঘটনা আমাদেরকে বিপদে ধৈর্য ধরার প্রেরণা দেয়।

৬. ইউসুফ (আ.)-এর জীবনের পূর্ণতা ও পিতার সঙ্গে পুনর্মিলন

হজরত ইউসুফ (আ.)-কে তাঁর ভাইয়েরা ঈর্ষাবশত কূপে ফেলে দেয়। এক কাফেলা তাঁকে উদ্ধার করে এবং মিসরে বিক্রি করে দেয়। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তিনি মিসরের প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন। দীর্ঘ ৪০ বছর পর তাঁর পিতা হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর সঙ্গে মিলিত হন এবং তা আশুরার দিনেই ঘটেছিল। এটি ছিল পারিবারিক মমতা, ধৈর্য ও আল্লাহর পরিকল্পনার এক অপূর্ব নিদর্শন।

৭. ইউনুস (আ.)-এর মুক্তি ও দোয়ার ফল

হজরত ইউনুস (আ.) তাঁর কওমের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া শহর ত্যাগ করেন। মাঝনদীতে ঝড়ের কবলে পড়লে তাঁকে এক বিশাল মাছ গিলে ফেলে। তিনি মাছের পেটে ৪০ দিন অবস্থান করে তাওবা করেন ও আল্লাহর জিকির করেন—“লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা, ইন্নি কুন্তু মিনাজ্জালেমিন।” অবশেষে আশুরার দিনই আল্লাহ তাঁকে মুক্তি দেন এবং মাছ তাঁকে নদীর তীরে ফেলে দেয়।

৮. মুসা (আ.)-এর রক্ষা ও ফেরাউনের ধ্বংস

ফেরাউন তাঁর রাজত্বে হজরত মুসা (আ.)-এর উপর অত্যাচার শুরু করলে আল্লাহর নির্দেশে মুসা (আ.) তাঁর কওমকে নিয়ে পালিয়ে যান। ফেরাউন তাঁদের অনুসরণ করে। তখন আল্লাহ নীল নদকে দ্বিখণ্ডিত করে মুসা ও তাঁর অনুসারীদের জন্য পথ করে দেন। তাঁরা পার হন, কিন্তু ফেরাউন ও তার বাহিনী নদীতে ডুবে ধ্বংস হয়। এটি আশুরার দিন ঘটেছিল। এই দিনেই রোযা রাখতেন রাসূলুল্লাহ (সা.)।

৯. ঈসা (আ.)-এর আসমানে উত্তোলন

হজরত ঈসা (আ.)-কে তাঁর কওম হত্যার চেষ্টা করলে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জীবিত অবস্থায় আকাশে উত্তোলন করেন। বিশ্বাস করা হয়, এই ঘটনাটিও ১০ মহররম, আশুরার দিন সংঘটিত হয়েছিল। এটি ছিল আল্লাহর কুদরতের আরেক নিদর্শন এবং নবীদের সম্মান ও নিরাপত্তার প্রমাণ।

১০. কারবালার হৃদয়বিদারক শহীদি ঘটনা

ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে শোকাবহ ও বিয়োগাত্মক ঘটনা—কারবালার যুদ্ধ—হয় ৬১ হিজরির ১০ মহররম। মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবার ইয়াজিদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য কারবালায় রওনা হন। তাঁরা খাদ্য ও পানির অভাবে এক এক করে শহীদ হন। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগ সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে এক চিরন্তন সংগ্রামের প্রতীক।

পবিত্র আশুরার দিনে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনা আমাদের একটি করে বড় শিক্ষা দেয়—তাওবা, ধৈর্য, আল্লাহর প্রতি আস্থা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, এবং জীবনের প্রতিটি অবস্থায় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবিচল থাকার দৃঢ় সংকল্প। এই দিনকে কেবল শোক নয়, আত্মশুদ্ধি ও রুহানিয়াতের দিন হিসেবে পালন করাই প্রকৃত ইসলামী চেতনার বহিঃপ্রকাশ।