১০:০৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সৌদিতে মৃত্যুদণ্ডের বন্যা: এবার শিকার দুই ইথিওপীয়

মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষণশীল রাষ্ট্র সৌদি আরবে মাদক সংক্রান্ত মামলায় দোষী সাব্যস্ত দুই ইথিওপীয় নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘‘খলিল কাসিম মুহাম্মদ ওমর’’ এবং ‘‘মুরাদ ইয়াকুব আদম সিয়ো’’ নামের এই দুই ব্যক্তি হাশিশ পাচারের দায়ে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর করা হয়েছে।

সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম সৌদি প্রেস এজেন্সির (এসপিএ) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদালতের রায়ে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের যথাযথ প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ নিয়ে ২০২৫ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সৌদি আরবে ১০১ জন বিদেশি নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো। একই সময়ে মোট মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে ১৮৯টি, যার মধ্যে ৮৮ জন সৌদি নাগরিক।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরব বিশ্বের শীর্ষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকারী দেশগুলোর একটি। ২০২৪ সালে দেশটিতে মোট ৩৩৮টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। আগের বছর ২০২৩ সালে এটি ছিল ১৭০ এবং ২০২২ সালে ছিল ১৯৬।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি আরবে অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রায়শই দ্রুত ও গোপন বিচার প্রক্রিয়ায় দেওয়া হয়, যেখানে বিচারাধীন ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত আইনি সহায়তা থাকে না। বিশেষ করে বিদেশি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এ প্রবণতা আরও বেশি লক্ষ্য করা যায়।

এই সর্বোচ্চ সাজা কার্যকরের ঘটনায় আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘মাদক সংশ্লিষ্ট অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং ন্যায্য বিচারের নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’’

অ্যামনেস্টির মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক উপ-পরিচালক ক্রিস্টিন বেকারলে বলেন, “আমরা একটি ভয়ঙ্কর প্রবণতা দেখছি, যেখানে বিদেশিদের এমন অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে যা কখনই এই ধরনের শাস্তির আওতায় পড়া উচিত নয়। বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার অভাব এবং নাগরিকত্ব না থাকায় তারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”

আরেকটি প্রভাবশালী সংগঠন রিপ্রিভ জানিয়েছে, চলতি বছরে সৌদিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের অর্ধেকেরও বেশি বিদেশি, যার অধিকাংশই মাদক সংক্রান্ত মামলার শিকার। সংস্থাটির মধ্যপ্রাচ্য মৃত্যুদণ্ড প্রকল্পের প্রধান জিদ বাসিউনি কড়া সমালোচনা করে বলেন, “ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সৌদি আরবে আপনি মরুভূমির রেভ পার্টিতে অংশ নিতে পারবেন, আবার হাশিশ খাওয়ার জন্য মৃত্যুদণ্ডও পাবেন। এটি নিপীড়নের নতুন এক বাস্তবতা।”

প্রসঙ্গত, সৌদি সরকার ২০২০ সালে মানবিক দিক বিবেচনায় মাদক মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে অস্থায়ী স্থগিতাদেশ দেয়। তবে ২০২২ সালের শেষ দিকে দেশটি আবারও মাদক-সংক্রান্ত অপরাধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা শুরু করে। এরপর থেকেই মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী।

বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং পর্যবেক্ষকদের মতে, সৌদি আরবে বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার ঘাটতি, আইনজীবীর পর্যাপ্ত সুযোগ না পাওয়া এবং নির্যাতনের অভিযোগসহ নানা অনিয়ম নিয়মিতভাবে উঠে আসে। বিদেশিদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে, কারণ তারা ভাষাগত বাধা ও রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণে নিজেদের পক্ষে উপযুক্তভাবে লড়তে পারেন না।

একদিকে সৌদি আরব উদার সংস্কার ও আধুনিকায়নের বার্তা দিয়ে বিশ্ববাসীর সামনে নতুন চেহারা তুলে ধরার চেষ্টা করছে—যেমন: নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি, সিনেমা হল খোলা, আন্তর্জাতিক কনসার্ট ও খেলাধুলা আয়োজন। অন্যদিকে সমান্তরালভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মতো চরম দমনমূলক নীতিও চালিয়ে যাচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে বিপজ্জনক দ্বিমুখী অবস্থান বলে বিবেচিত হচ্ছে।

ট্যাগ

সৌদিতে মৃত্যুদণ্ডের বন্যা: এবার শিকার দুই ইথিওপীয়

প্রকাশিত হয়েছে: ০৭:১৬:২৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫

মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষণশীল রাষ্ট্র সৌদি আরবে মাদক সংক্রান্ত মামলায় দোষী সাব্যস্ত দুই ইথিওপীয় নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘‘খলিল কাসিম মুহাম্মদ ওমর’’ এবং ‘‘মুরাদ ইয়াকুব আদম সিয়ো’’ নামের এই দুই ব্যক্তি হাশিশ পাচারের দায়ে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর করা হয়েছে।

সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম সৌদি প্রেস এজেন্সির (এসপিএ) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদালতের রায়ে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের যথাযথ প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ নিয়ে ২০২৫ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সৌদি আরবে ১০১ জন বিদেশি নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো। একই সময়ে মোট মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে ১৮৯টি, যার মধ্যে ৮৮ জন সৌদি নাগরিক।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরব বিশ্বের শীর্ষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকারী দেশগুলোর একটি। ২০২৪ সালে দেশটিতে মোট ৩৩৮টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। আগের বছর ২০২৩ সালে এটি ছিল ১৭০ এবং ২০২২ সালে ছিল ১৯৬।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি আরবে অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রায়শই দ্রুত ও গোপন বিচার প্রক্রিয়ায় দেওয়া হয়, যেখানে বিচারাধীন ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত আইনি সহায়তা থাকে না। বিশেষ করে বিদেশি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এ প্রবণতা আরও বেশি লক্ষ্য করা যায়।

এই সর্বোচ্চ সাজা কার্যকরের ঘটনায় আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘মাদক সংশ্লিষ্ট অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং ন্যায্য বিচারের নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’’

অ্যামনেস্টির মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক উপ-পরিচালক ক্রিস্টিন বেকারলে বলেন, “আমরা একটি ভয়ঙ্কর প্রবণতা দেখছি, যেখানে বিদেশিদের এমন অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে যা কখনই এই ধরনের শাস্তির আওতায় পড়া উচিত নয়। বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার অভাব এবং নাগরিকত্ব না থাকায় তারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”

আরেকটি প্রভাবশালী সংগঠন রিপ্রিভ জানিয়েছে, চলতি বছরে সৌদিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের অর্ধেকেরও বেশি বিদেশি, যার অধিকাংশই মাদক সংক্রান্ত মামলার শিকার। সংস্থাটির মধ্যপ্রাচ্য মৃত্যুদণ্ড প্রকল্পের প্রধান জিদ বাসিউনি কড়া সমালোচনা করে বলেন, “ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সৌদি আরবে আপনি মরুভূমির রেভ পার্টিতে অংশ নিতে পারবেন, আবার হাশিশ খাওয়ার জন্য মৃত্যুদণ্ডও পাবেন। এটি নিপীড়নের নতুন এক বাস্তবতা।”

প্রসঙ্গত, সৌদি সরকার ২০২০ সালে মানবিক দিক বিবেচনায় মাদক মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে অস্থায়ী স্থগিতাদেশ দেয়। তবে ২০২২ সালের শেষ দিকে দেশটি আবারও মাদক-সংক্রান্ত অপরাধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা শুরু করে। এরপর থেকেই মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী।

বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং পর্যবেক্ষকদের মতে, সৌদি আরবে বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার ঘাটতি, আইনজীবীর পর্যাপ্ত সুযোগ না পাওয়া এবং নির্যাতনের অভিযোগসহ নানা অনিয়ম নিয়মিতভাবে উঠে আসে। বিদেশিদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে, কারণ তারা ভাষাগত বাধা ও রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণে নিজেদের পক্ষে উপযুক্তভাবে লড়তে পারেন না।

একদিকে সৌদি আরব উদার সংস্কার ও আধুনিকায়নের বার্তা দিয়ে বিশ্ববাসীর সামনে নতুন চেহারা তুলে ধরার চেষ্টা করছে—যেমন: নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি, সিনেমা হল খোলা, আন্তর্জাতিক কনসার্ট ও খেলাধুলা আয়োজন। অন্যদিকে সমান্তরালভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মতো চরম দমনমূলক নীতিও চালিয়ে যাচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে বিপজ্জনক দ্বিমুখী অবস্থান বলে বিবেচিত হচ্ছে।