১১:১৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ৩০ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

তিব্বতে মেগা-বাঁধ শুরু, শঙ্কায় ভারত-বাংলাদেশ

হিমালয়ের পাদদেশে, যেখানে একসময় গড়ে উঠেছিল প্রাচীন ইয়ারলুং সভ্যতা এবং তিব্বতীয় প্রথম সাম্রাজ্য—সেই ঐতিহাসিক অঞ্চলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করেছে এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তি চীন। শনিবার (১৯ জুলাই) তিব্বতের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ইয়ারলুং জাংবো নদীতে ৬০ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মেগা-বাঁধের নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং।

ইয়ারলুং জাংবো নদীটি ভারতের অরুণাচল ও অসম এবং বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ‘ব্রহ্মপুত্র’ নামে পরিচিত। এই নদীর ওপর নির্ভরশীল দুই দেশের কোটি কোটি মানুষের কৃষি, পানি ও জীবিকা। তাই নদীর উৎসমুখে চীনের এমন একটি মেগা প্রকল্প শুরু করায় উদ্বেগ ছড়িয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ও পরিবেশবিদ মহলে।

চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া জানায়, জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি তিব্বতের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্য রয়েছে এই প্রকল্পের। ২০২০ সালে প্রকল্পের পরিকল্পনা ঘোষণা করে বেইজিং, আর ২০২4 সালের ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্প অনুমোদন পায়।

চীন জানিয়েছে, ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে তিব্বতে এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্পটিতে পাঁচটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে এবং এর সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১.২ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (১৬৭.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)।

তবে পরিবেশবিদরা এই বাঁধ প্রকল্পের বিরুদ্ধে গুরুতর আপত্তি তুলেছেন। তাদের মতে, এটি পরিবেশগতভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল তিব্বত মালভূমিতে অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। এর ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হতে পারে এবং বহু প্রজাতির জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়বে। পাশাপাশি, নদীর নিম্নপ্রবাহে থাকা দেশগুলোতে পানির প্রবাহ হ্রাস পেলে ভয়াবহ মানবিক ও কৃষি সংকট দেখা দিতে পারে।

ভারত ইতোমধ্যেই এই প্রকল্প নিয়ে নিজেদের উদ্বেগ জানিয়েছে চীনকে। নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা তিব্বতে চীনের বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “উজানে চীনের যেকোনো কার্যক্রম যেন ভাটির দেশগুলোর স্বার্থ ক্ষুণ্ন না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে।”

চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই প্রকল্পে ভাটির দিকে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না এবং তারা নিম্নপ্রবাহের দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখবে।

এর আগে চীনের ইয়াংজি নদীতে নির্মিত থ্রি গর্জেস বাঁধ বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হিসেবে পরিচিত ছিল। নতুন এই ইয়ারলুং জাংবো বাঁধ সেটিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তবে থ্রি গর্জেস প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় চীন ১৪ লাখের বেশি মানুষকে জোরপূর্বক স্থানান্তর করেছিল। এবারও একই পরিণতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। গ্লোবাল টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে তিব্বতের মিডগ কাউন্টিতে, যার জনসংখ্যা মাত্র ১৪ হাজার। প্রকল্পের কারণে কতজনকে সেখান থেকে স্থানান্তর করতে হবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো তথ্য জানায়নি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না।

২৫ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের তিব্বত মালভূমি হিমালয়ের গলে পড়া বরফ, পাহাড়ি ঝরনা ও প্রাকৃতিক স্রোতের এক বিশাল আধার, যেখান থেকে ভারত, চীন ও ভুটানসহ অন্তত ১৮০ কোটি মানুষ পানীয় জল ও কৃষির জন্য পানি পায়। ফলে এই অঞ্চলে নদীর প্রবাহে সামান্য পরিবর্তনও হতে পারে বহু দেশের জন্য বিপর্যয়কর।

ট্যাগ

তিব্বতে মেগা-বাঁধ শুরু, শঙ্কায় ভারত-বাংলাদেশ

প্রকাশিত হয়েছে: ০৮:৪১:০৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫

হিমালয়ের পাদদেশে, যেখানে একসময় গড়ে উঠেছিল প্রাচীন ইয়ারলুং সভ্যতা এবং তিব্বতীয় প্রথম সাম্রাজ্য—সেই ঐতিহাসিক অঞ্চলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করেছে এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তি চীন। শনিবার (১৯ জুলাই) তিব্বতের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ইয়ারলুং জাংবো নদীতে ৬০ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মেগা-বাঁধের নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং।

ইয়ারলুং জাংবো নদীটি ভারতের অরুণাচল ও অসম এবং বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ‘ব্রহ্মপুত্র’ নামে পরিচিত। এই নদীর ওপর নির্ভরশীল দুই দেশের কোটি কোটি মানুষের কৃষি, পানি ও জীবিকা। তাই নদীর উৎসমুখে চীনের এমন একটি মেগা প্রকল্প শুরু করায় উদ্বেগ ছড়িয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ও পরিবেশবিদ মহলে।

চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া জানায়, জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি তিব্বতের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্য রয়েছে এই প্রকল্পের। ২০২০ সালে প্রকল্পের পরিকল্পনা ঘোষণা করে বেইজিং, আর ২০২4 সালের ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্প অনুমোদন পায়।

চীন জানিয়েছে, ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে তিব্বতে এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্পটিতে পাঁচটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে এবং এর সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১.২ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (১৬৭.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)।

তবে পরিবেশবিদরা এই বাঁধ প্রকল্পের বিরুদ্ধে গুরুতর আপত্তি তুলেছেন। তাদের মতে, এটি পরিবেশগতভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল তিব্বত মালভূমিতে অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। এর ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হতে পারে এবং বহু প্রজাতির জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়বে। পাশাপাশি, নদীর নিম্নপ্রবাহে থাকা দেশগুলোতে পানির প্রবাহ হ্রাস পেলে ভয়াবহ মানবিক ও কৃষি সংকট দেখা দিতে পারে।

ভারত ইতোমধ্যেই এই প্রকল্প নিয়ে নিজেদের উদ্বেগ জানিয়েছে চীনকে। নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা তিব্বতে চীনের বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “উজানে চীনের যেকোনো কার্যক্রম যেন ভাটির দেশগুলোর স্বার্থ ক্ষুণ্ন না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে।”

চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই প্রকল্পে ভাটির দিকে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না এবং তারা নিম্নপ্রবাহের দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখবে।

এর আগে চীনের ইয়াংজি নদীতে নির্মিত থ্রি গর্জেস বাঁধ বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হিসেবে পরিচিত ছিল। নতুন এই ইয়ারলুং জাংবো বাঁধ সেটিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তবে থ্রি গর্জেস প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় চীন ১৪ লাখের বেশি মানুষকে জোরপূর্বক স্থানান্তর করেছিল। এবারও একই পরিণতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। গ্লোবাল টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে তিব্বতের মিডগ কাউন্টিতে, যার জনসংখ্যা মাত্র ১৪ হাজার। প্রকল্পের কারণে কতজনকে সেখান থেকে স্থানান্তর করতে হবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো তথ্য জানায়নি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না।

২৫ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের তিব্বত মালভূমি হিমালয়ের গলে পড়া বরফ, পাহাড়ি ঝরনা ও প্রাকৃতিক স্রোতের এক বিশাল আধার, যেখান থেকে ভারত, চীন ও ভুটানসহ অন্তত ১৮০ কোটি মানুষ পানীয় জল ও কৃষির জন্য পানি পায়। ফলে এই অঞ্চলে নদীর প্রবাহে সামান্য পরিবর্তনও হতে পারে বহু দেশের জন্য বিপর্যয়কর।