রাষ্ট্রীয় মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে আজ বৃহস্পতিবার ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ চূড়ান্ত করার দিন নির্ধারিত থাকলেও প্রক্রিয়াটি ঘিরে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। কারণ, বাস্তবায়ন পদ্ধতি ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো ঐকমত্য তৈরি হয়নি।
গত বছরের অক্টোবর থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গঠিত ছয়টি পৃথক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনার মাধ্যমে গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। প্রস্তাবিত সংস্কারগুলোর মধ্যে যেসব বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, তার ভিত্তিতেই তৈরি হওয়ার কথা ‘জুলাই জাতীয় সনদ’।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে খসড়া সনদ দলগুলোকে দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে—যেসব সংস্কার প্রস্তাব এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে, সেগুলো আগামী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে। এই প্রস্তাবই বিতর্কের মূল কেন্দ্রে।
জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সহ একাধিক দল এই বাস্তবায়ন পদ্ধতিকে “আইনগত ভিত্তিহীন” ও “দায়িত্ব এড়ানোর কৌশল” হিসেবে উল্লেখ করে খোলাখুলি আপত্তি জানিয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন,
“খসড়ায় যেভাবে বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে, তা দেখে আমি হতবাক এবং হতাশ। যদি জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না থাকে, তাহলে এত দিনের আলোচনা ও প্রচেষ্টা মূল্যহীন।”
এই বক্তব্যের পরও ঐকমত্য কমিশন বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে এখনই আলোচনা করতে রাজি হয়নি। সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন,
“কমিশন আগে সনদের খসড়া চূড়ান্ত করতে চায়, তারপর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হবে।”
নারী প্রতিনিধিত্ব:
বিদ্যমান ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন ২০৪৩ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে।
৩০০ আসনের মধ্যে প্রথমে ৫%, পরে ১০% এবং ধাপে ধাপে ৩৩% পর্যন্ত নারী প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে।
এটি সংবিধানে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল ও ক্ষমতা সীমিতকরণ:
এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন।
একজন ব্যক্তি একই সময়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।
অন্যান্য সিদ্ধান্ত:
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন।
প্রধান বিচারপতি ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গঠনপদ্ধতি সংবিধানে যুক্ত।
হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণ ও উপজেলা পর্যায়ে নিম্ন আদালত স্থানান্তর।
জরুরি অবস্থা জারি সংক্রান্ত বিধান সংশোধন।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্বে পরিবর্তন।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ:
উচ্চকক্ষ গঠনের নীতিতে দলগুলো একমত হলেও, নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে মতানৈক্য।
জামায়াত, এনসিপি প্রস্তাবিত PR (Proportional Representation) পদ্ধতির পক্ষে, কিন্তু বিএনপিসহ কয়েকটি দল এতে দ্বিমত পোষণ করেছে।
রাষ্ট্রপতির নির্বাচন ও ক্ষমতা:
রাষ্ট্রপতির কিছু ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়াই প্রয়োগ করার প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
রাষ্ট্রের মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার:
সংবিধানে নাগরিকদের অধিকার সম্প্রসারণ নিয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত আলোচনা হয়নি।
রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি বিপরীতমুখী।
সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়া:
সরকারি কর্ম কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও ন্যায়পাল নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়গুলো সংবিধানে যুক্ত করা নিয়ে বিএনপির আপত্তি রয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এখন পর্যন্ত দুটি পর্বে আলোচনা করেছে। প্রথম পর্বে ৩৩টি দলের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে ৬২টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়। দ্বিতীয় পর্বে, ২০টির বেশি মৌলিক বিষয়ে একসঙ্গে বসে আলোচনা হয় এবং এখন পর্যন্ত ১৪টি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
গতকাল রাতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বেশ কিছু নতুন ধারণাপত্র বিতরণ করা হয় এবং প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কমিশনের সদস্যদের বৈঠকও হয়। সেখানে কমিশনকে কিছু কৌশলগত দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তবে যে বিষয়টি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটি হলো জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আইনি নিশ্চয়তা। রাজনৈতিক দলগুলো বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নে এখানে স্পষ্ট নিশ্চয়তা চায়। নতুবা তারা এই উদ্যোগকে “রাজনৈতিক সময়ক্ষেপণ” হিসেবে দেখছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন,
“আপনারা যে দায়িত্ব আমাদের দিয়েছেন, তার মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমরা চেষ্টা করছি এসব বিষয়ে দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছাতে এবং আজকের মধ্যেই আপনাদের সামনে একটি গ্রহণযোগ্য খসড়া সনদ তুলে দিতে পারব বলে আশা করছি।”
একটি ঐক্যমত্যভিত্তিক সনদের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রচেষ্টা এখন দ্বিধার মুখে। বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও ঐকমত্যের ঘাটতির কারণে ৩১ জুলাই চূড়ান্ত সনদ ঘোষণার লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে কি না, সে প্রশ্ন এখন প্রকট।
প্রকাশক ও সম্পাদক
© কপিরাইট সমাচার বিশ্ব ২০২৫ | আমাদের ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।