বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক রচনা করে মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে অনুষ্ঠিত ‘জুলাই পুনর্জাগরণ’ সমাবেশে পাঠ করা হলো ২৮ দফার ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন, যা ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান এবং দীর্ঘ ষোল বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে প্রণীত।
ঘোষণাপত্রে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে, এবং এই ঘোষণাপত্র পরবর্তী নির্বাচনে গঠিত সরকার কর্তৃক সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
নিচে "জুলাই ঘোষণাপত্র ২০২৪"-এর ২৮ দফাকে এক এক করে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো, যেন প্রতিটি দফার তাৎপর্য এবং প্রেক্ষাপট পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। এতে ইতিহাস, রাজনৈতিক বাস্তবতা ও জনগণের দাবি–সবকিছু যুক্ত করা হয়েছে:
বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানি শোষণ, বঞ্চনা ও গণহত্যার বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জাতি যুদ্ধ শুরু করে, যার লক্ষ্য ছিল একটি শোষণমুক্ত, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
জনগণ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ঘোষিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য অকল্পনীয় ত্যাগ স্বীকার করে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের পদ্ধতি, কাঠামোগত দুর্বলতা এবং এর অপব্যবহার জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়। এতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা হ্রাস পায়।
আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান সংশোধন করে বাকশালের মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম করে। এতে মতপ্রকাশ, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়। এর প্রতিবাদেই ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লব ঘটে।
আশির দশকে ছাত্র-জনতার নয় বছরব্যাপী আন্দোলনে ১৯৯০ সালে সামরিক স্বৈরশাসনের পতন ঘটে এবং ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
বিদেশি সমর্থিত ষড়যন্ত্রমূলক ‘১/১১’ হস্তক্ষেপে নির্বাচন বিলম্বিত হয়, যার মাধ্যমে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে সংবিধানকে অবৈধভাবে পরিবর্তন করে এবং একদলীয় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করে।
গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, সংবিধান পরিবর্তন ইত্যাদির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হয়।
এই দুঃশাসনের ফলে বাংলাদেশ একটি ফ্যাসিবাদী, মাফিয়া ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়।
উন্নয়নের নামে সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার ও প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহারের ফলে অর্থনীতি, পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্ভাবনা ধ্বংস হয়।
বিগত ষোলো বছরে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনের ওপর দমন-পীড়ন, মামলা, হামলা, গুম ও হত্যা চালানো হয়।
বিদেশি আগ্রাসন ও অন্যায় খবরদারিত্বের বিরুদ্ধে জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে আওয়ামী লীগ সরকার কঠোরভাবে দমন করে।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে ক্ষমতা অব্যাহত রাখা হয়।
সরকারি নিয়োগে দলীয়করণ, কোটানির্ভর বৈষম্য ও ভিন্নমতের ওপর দমন-পীড়ন তরুণ প্রজন্মকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর চরম নিপীড়নের ফলে জনরোষ বাড়তে থাকে, যা দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে পরিণত হয়।
ছাত্র আন্দোলন দমন করতে সরকার গণহত্যা ও নির্যাতনের পথ বেছে নেয়, যা দেশজুড়ে উত্তাল গণআন্দোলনের জন্ম দেয়।
আওয়ামী লীগ সরকার নারী-শিশুসহ প্রায় এক হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা জনগণের পক্ষে অবস্থান নেয়।
৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে গণভবনমুখী জনতার অভিযাত্রার মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগে বাধ্য হন ও দেশত্যাগ করেন।
এই অভ্যুত্থান ছিল জনগণের সার্বভৌমতার যথার্থ প্রকাশ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের পথ।
৮ আগস্ট ২০২৪, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের আলোকে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।
এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণ একটি বৈষম্য, ফ্যাসিবাদ ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের স্পষ্ট অভিপ্রায় ব্যক্ত করে।
জনগণ চায় সুশাসন, সুষ্ঠু নির্বাচন, আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনঃগঠন ও সংস্কার।
গুম, খুন, হত্যা, লুণ্ঠন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দ্রুত ও নিরপেক্ষ বিচার জনগণের দৃঢ় অভিপ্রায়।
জুলাই অভ্যুত্থনে নিহত সকল শহীদদের জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা এবং আহত ও যোদ্ধাদের আইনগত সুরক্ষা ও পুনর্বাসন দাবি করা হয়েছে।
একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের মাধ্যমে একটি নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ব্যক্ত হয়েছে।
জনগণ চায় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই ও জলবায়ু-সহিষ্ণু উন্নয়ন কৌশল, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার রক্ষা করবে।
২০২৪ সালের ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে এই ঘোষণাপত্র সংবিধানের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানানো হয়েছে।
৫ আগস্ট ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানে বিজয়ী জনগণের অভিপ্রায়, আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যয়ের প্রতিফলন হিসেবে এই জুলাই ঘোষণাপত্র ২০২৪ প্রণীত হয়েছে।
প্রকাশক ও সম্পাদক
© কপিরাইট সমাচার বিশ্ব ২০২৫ | আমাদের ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।