আওয়ামী লীগের শাসনামলে হওয়া তিনটি জাতীয় নির্বাচনকে “একতরফা, ডামি ও নিশিরাতের ভোট” আখ্যা দিয়েছেন সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এসব নির্বাচনের প্রভাবেই পুলিশ বাহিনীতে রাজনৈতিক মেরুকরণ তৈরি হয় এবং গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক এক বলয় গড়ে ওঠে বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নিজের জবানবন্দিতে বিস্ফোরক তথ্য দেন তিনি।
গতকাল মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ৩৬তম সাক্ষী হিসেবে হাজির হয়ে এসব তথ্য তুলে ধরেন মামুন। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন প্যানেল তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
সাক্ষ্যে মামুন জানান, তিনি ১৯৮৬ ব্যাচের কর্মকর্তা হিসেবে পুলিশে যোগ দিয়ে তিন দশকের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারি অবসরে যাওয়ার কথা থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের সিদ্ধান্তে দুবার তার আইজিপি পদে মেয়াদ বাড়ানো হয়। তিনি বলেন, এর অন্যতম কারণ ছিল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে গ্রুপিং আড়াল রাখা।
সাবেক আইজিপি বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক মেরুকরণ ব্যাপক আকার ধারণ করে। গোপালগঞ্জ জেলার কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আসীন হয়ে সরকারের সরাসরি এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখেন। তাদের প্রভাব এমন পর্যায়ে যায় যে, তারা আইজিপির নির্দেশও মানতে চাইতেন না।
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়কার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে মামুন বলেন, তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী শেখ হাসিনাকে রাতের ভোটের কৌশল দেন। তার পরামর্শে ভোটের আগের রাতেই ৫০ শতাংশ ব্যালট বাক্সে ব্যালট ভরে রাখতে নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা। এই নির্দেশ মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করেন ডিসি, এসপি, ইউএনও, এসিল্যান্ড, ওসি এবং দলীয় নেতারা। নির্বাচনের পর যারা এ কাজে সহযোগিতা করেন, তাদের রাষ্ট্রীয় পদক দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়।
তিনি আরও জানান, আওয়ামী লীগ টানা চার মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার সময়ে পুলিশ বাহিনীতে পেশাদারিত্ব নষ্ট হয়ে যায়। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলোতে গোপালগঞ্জ জেলার কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। এর ফলে বাহিনী মূলত রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হতে থাকে।
র্যাব মহাপরিচালক থাকা অবস্থায় টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন সেলসহ বন্দিশালার ভয়াবহতা, এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমন পরিকল্পনার নীলনকশাও তার জবানবন্দিতে উঠে আসে। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে সে সময় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। একই সঙ্গে নিজের দায় স্বীকার করে শহীদ-আহত পরিবার, দেশবাসী ও আদালতের কাছে ক্ষমা চান মামুন।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, সাবেক আইজিপির সাক্ষ্য শেখ হাসিনার দুঃশাসনের অকাট্য দলিল। এটি শুধু জুলাই-আগস্টের গণহত্যা নয়, গত ১৫ বছরে সংঘটিত গুম-খুনের বিরুদ্ধেও শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে। তবে মামুন ক্ষমা পাবেন কিনা, সেটি আদালতের এখতিয়ার।
প্রকাশক ও সম্পাদক
© কপিরাইট সমাচার বিশ্ব ২০২৫ | আমাদের ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।