০৩:৪৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ৩০ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গণভবনের গোপন বৈঠকের তথ্য ফাঁস করলেন সাবেক আইজিপি মামুন

২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সারা দেশ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে এবং পরদিন ঘোষিত হয় ঐতিহাসিক ‘মার্চ টু ঢাকা’। এর আগের রাতেই গণভবনে বৈঠকে বসেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শেখ রেহানা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তিন বাহিনীর প্রধান, র‌্যাব ডিজি, ডিজিএফআই ও এনএসআই প্রধানসহ ২৭ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বৈঠকে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন ও নিয়ন্ত্রণের কৌশল নির্ধারণ করা হয়। বিকেলের বৈঠক দ্রুত মুলতবি হলেও রাতের বৈঠকে পুনরায় বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ৫ আগস্টের ‘মার্চ টু ঢাকা’ ঠেকাতে সেনা ও পুলিশের সমন্বয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকার প্রবেশমুখে সেনা-পুলিশ মোতায়েনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয় এবং গভীর রাতে সবাই আর্মির অপারেশন কন্ট্রোল রুমে বৈঠক শেষে সরে আসেন। ৫ আগস্ট সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকতে থাকে স্রোতের মতো ছাত্র-জনতা। দুপুর নাগাদ খবর আসে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়বেন, তবে তিনি কোথায় যাবেন তা অজ্ঞাত থেকে যায়। বিকেলে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রথমে তেজগাঁও বিমানবন্দর, সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। একইভাবে পুলিশ ও এসবি’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও একে একে ক্যান্টনমেন্টে সরিয়ে আনা হয়। পরে ৬ আগস্ট মামুনের আইজিপি পদ বাতিল করা হয় এবং ৩ সেপ্টেম্বর তাকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৭ জুলাই আন্দোলন চলাকালে নারায়ণগঞ্জ সফরের কথাও জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন তিনি, যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালকে ওয়ারি জোনের ডিসি একটি ভিডিও দেখান এবং গুলি করলে একজন নিহত বা আহত হলে বাকিরা ভয়ে সরে যাবে বলে মন্তব্য করেন। আরও গুরুতর তথ্য উঠে আসে ১৮ জুলাইয়ের ঘটনার প্রসঙ্গে। মামুন জানান, সেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল ফোনে জানান যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশ সারাদেশে পুলিশ কর্মকর্তাদের জানিয়ে দেওয়া হয় এবং তখন থেকেই আন্দোলন দমনে লেথাল উইপেন ব্যবহার শুরু হয়। বিশেষ করে ডিএমপি কমিশনার হাবিব ও ডিবির হারুন মারণাস্ত্র ব্যবহারে অতিউৎসাহী ছিলেন। মামুন সাক্ষ্যে জানান, প্রধানমন্ত্রীকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে প্ররোচিত করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, মেয়র ফজলে নূর তাপস, উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মির্জা আযম, হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেননসহ একাধিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। শুধু রাজনৈতিক নেতারাই নয়, আওয়ামীপন্থি বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী ও ব্যবসায়ীরাও আন্দোলন দমনে সরকারকে উৎসাহিত করেছিলেন। ছাত্র-জনতার ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও গণহত্যার ঘটনায় নিজের অপরাধবোধের কথা অকপটে স্বীকার করেন সাবেক আইজিপি মামুন। তিনি ট্রাইব্যুনালে বলেন, দায়িত্বে থেকে এমন নৃশংসতায় ভূমিকা রাখার কারণে আমি অনুতপ্ত, আমি লজ্জিত। স্বজন হারানোদের কান্না, ভিডিওতে ধরা নৃশংসতা এবং বিশেষ করে আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর বিভৎসতা আমাকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। তাই বিবেকের তাড়নায় আমি রাজসাক্ষী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশেই এই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তবে আমি দায়িত্বে থাকার কারণে দায় স্বীকার করছি। একইসঙ্গে প্রতিটি শহীদ পরিবারের কাছে, আহত মানুষদের কাছে, দেশবাসীর কাছে এবং ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি—আমাকে দয়া করে ক্ষমা করবেন।

ট্যাগ

গণভবনের গোপন বৈঠকের তথ্য ফাঁস করলেন সাবেক আইজিপি মামুন

প্রকাশিত হয়েছে: ১২:৪০:৩১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সারা দেশ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে এবং পরদিন ঘোষিত হয় ঐতিহাসিক ‘মার্চ টু ঢাকা’। এর আগের রাতেই গণভবনে বৈঠকে বসেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শেখ রেহানা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তিন বাহিনীর প্রধান, র‌্যাব ডিজি, ডিজিএফআই ও এনএসআই প্রধানসহ ২৭ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বৈঠকে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন ও নিয়ন্ত্রণের কৌশল নির্ধারণ করা হয়। বিকেলের বৈঠক দ্রুত মুলতবি হলেও রাতের বৈঠকে পুনরায় বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ৫ আগস্টের ‘মার্চ টু ঢাকা’ ঠেকাতে সেনা ও পুলিশের সমন্বয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকার প্রবেশমুখে সেনা-পুলিশ মোতায়েনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয় এবং গভীর রাতে সবাই আর্মির অপারেশন কন্ট্রোল রুমে বৈঠক শেষে সরে আসেন। ৫ আগস্ট সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকতে থাকে স্রোতের মতো ছাত্র-জনতা। দুপুর নাগাদ খবর আসে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়বেন, তবে তিনি কোথায় যাবেন তা অজ্ঞাত থেকে যায়। বিকেলে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রথমে তেজগাঁও বিমানবন্দর, সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। একইভাবে পুলিশ ও এসবি’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও একে একে ক্যান্টনমেন্টে সরিয়ে আনা হয়। পরে ৬ আগস্ট মামুনের আইজিপি পদ বাতিল করা হয় এবং ৩ সেপ্টেম্বর তাকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৭ জুলাই আন্দোলন চলাকালে নারায়ণগঞ্জ সফরের কথাও জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন তিনি, যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালকে ওয়ারি জোনের ডিসি একটি ভিডিও দেখান এবং গুলি করলে একজন নিহত বা আহত হলে বাকিরা ভয়ে সরে যাবে বলে মন্তব্য করেন। আরও গুরুতর তথ্য উঠে আসে ১৮ জুলাইয়ের ঘটনার প্রসঙ্গে। মামুন জানান, সেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল ফোনে জানান যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশ সারাদেশে পুলিশ কর্মকর্তাদের জানিয়ে দেওয়া হয় এবং তখন থেকেই আন্দোলন দমনে লেথাল উইপেন ব্যবহার শুরু হয়। বিশেষ করে ডিএমপি কমিশনার হাবিব ও ডিবির হারুন মারণাস্ত্র ব্যবহারে অতিউৎসাহী ছিলেন। মামুন সাক্ষ্যে জানান, প্রধানমন্ত্রীকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে প্ররোচিত করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, মেয়র ফজলে নূর তাপস, উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মির্জা আযম, হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেননসহ একাধিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। শুধু রাজনৈতিক নেতারাই নয়, আওয়ামীপন্থি বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী ও ব্যবসায়ীরাও আন্দোলন দমনে সরকারকে উৎসাহিত করেছিলেন। ছাত্র-জনতার ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও গণহত্যার ঘটনায় নিজের অপরাধবোধের কথা অকপটে স্বীকার করেন সাবেক আইজিপি মামুন। তিনি ট্রাইব্যুনালে বলেন, দায়িত্বে থেকে এমন নৃশংসতায় ভূমিকা রাখার কারণে আমি অনুতপ্ত, আমি লজ্জিত। স্বজন হারানোদের কান্না, ভিডিওতে ধরা নৃশংসতা এবং বিশেষ করে আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর বিভৎসতা আমাকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। তাই বিবেকের তাড়নায় আমি রাজসাক্ষী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশেই এই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তবে আমি দায়িত্বে থাকার কারণে দায় স্বীকার করছি। একইসঙ্গে প্রতিটি শহীদ পরিবারের কাছে, আহত মানুষদের কাছে, দেশবাসীর কাছে এবং ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি—আমাকে দয়া করে ক্ষমা করবেন।