০৭:১৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নেপালে রাজতন্ত্র বনাম প্রজাতন্ত্র: ব্যর্থতার আঁধারে নতুন স্লোগান

নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর রাস্তায় আবারও প্রতিধ্বনিত হলো পুরোনো এক স্লোগান—“রাজা ফিরবেনই”। জেন-জি প্রজন্মের নেতৃত্বে শুরু হওয়া আন্দোলনের প্রথম দুই দিনেই হাজারো মানুষ সাবেক নেপাল রাজ্যের পতাকা হাতে রাস্তায় নেমে আসেন।

গণতন্ত্রের অস্থিরতা, ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, থমকে যাওয়া অর্থনীতি এবং নির্বাচিত সরকারগুলোর পূর্ণ মেয়াদে টিকে থাকতে না পারার হতাশা মানুষকে আবারও রাজতন্ত্রের স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে।

ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে দ্রব্য শাহের হাত ধরে গোরখার ছোট্ট দুর্গ থেকে যে শাহ রাজবংশের সূচনা, তা ধীরে ধীরে পরিণত হয় সমগ্র নেপালের পরিচয়ে। ১৭৪৩ সালে পৃথী নারায়ণ শাহ যুদ্ধ ও কৌশলের জোরে ছিন্নভিন্ন রাজ্যগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে আধুনিক নেপাল রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন।

এরপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শাহ রাজারা কখনো নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধারী শাসক, কখনো প্রতীকী রাজা হিসেবে টিকে ছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চাপ, অ্যাংলো-নেপাল যুদ্ধ কিংবা অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র—সবকিছু সামলাতে হয়েছে তাদের।

কিন্তু ২০০১ সালের রাজপ্রাসাদ হত্যাকাণ্ড রাজতন্ত্রের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয়। রাজা বীরেন্দ্র ও তার পরিবার নিহত হওয়ার পর জ্ঞানেন্দ্র সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তার ক্ষমতা ছিল বিতর্কিত এবং কঠোর দমননীতির কারণে রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন তীব্রতর হয়।

২০০৮ সালে ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ঘোষণার মধ্য দিয়ে ২৩৯ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে।

২০০৮ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত ১৭ বছরে নেপালে ১৪টি সরকার পরিবর্তিত হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক মন্দা মানুষকে হতাশ করেছে। ফলে রাজতন্ত্রের প্রতি নস্টালজিয়া এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

২০২৫ সালের মার্চে ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে বিক্ষোভ করেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তবে প্রতীকী রাজা চাওয়ার দাবি এবং পরম ক্ষমতাধারী রাজতন্ত্রের প্রত্যাশা যে ভিন্ন দুটি বিষয়—তা নিয়েও বিতর্ক আছে।

রাজতন্ত্রপন্থীরা যুক্তি দিচ্ছেন, প্রতীকী রাজা ঐক্য, স্থিতিশীলতা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক হতে পারেন। তবে সমালোচকরা মনে করেন, বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্নীতিগ্রস্ত কাঠামো যদি অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে প্রতীকী রাজা তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারবেন না।

অন্যদিকে, জেন-জিদের আন্দোলন আসলে ভবিষ্যৎমুখী—তাদের মূল দাবি দুর্নীতি দমন, বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা ও কর্মসংস্থানের সমাধান। তাদের কাছে রাজতন্ত্রে ফেরা মানে পশ্চাৎপদতার দিকে ফিরে যাওয়া।

👉 নেপাল আজ দাঁড়িয়ে আছে এক জটিল সন্ধিক্ষণে। একদিকে ব্যর্থ প্রজাতন্ত্রের বাস্তবতা, অন্যদিকে রাজতন্ত্রের নস্টালজিয়া। কিন্তু ভবিষ্যতের প্রশ্নে জেন-জিদের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট—তারা স্থিতিশীলতা চান, তবে সেটি রাজতন্ত্রের ছায়ায় নয়, বরং গণতন্ত্রের নতুন রূপে।

ট্যাগ
জনপ্রিয় সংবাদ

নেপালে রাজতন্ত্র বনাম প্রজাতন্ত্র: ব্যর্থতার আঁধারে নতুন স্লোগান

প্রকাশিত হয়েছে: ০৮:০৫:৫৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর রাস্তায় আবারও প্রতিধ্বনিত হলো পুরোনো এক স্লোগান—“রাজা ফিরবেনই”। জেন-জি প্রজন্মের নেতৃত্বে শুরু হওয়া আন্দোলনের প্রথম দুই দিনেই হাজারো মানুষ সাবেক নেপাল রাজ্যের পতাকা হাতে রাস্তায় নেমে আসেন।

গণতন্ত্রের অস্থিরতা, ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, থমকে যাওয়া অর্থনীতি এবং নির্বাচিত সরকারগুলোর পূর্ণ মেয়াদে টিকে থাকতে না পারার হতাশা মানুষকে আবারও রাজতন্ত্রের স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে।

ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে দ্রব্য শাহের হাত ধরে গোরখার ছোট্ট দুর্গ থেকে যে শাহ রাজবংশের সূচনা, তা ধীরে ধীরে পরিণত হয় সমগ্র নেপালের পরিচয়ে। ১৭৪৩ সালে পৃথী নারায়ণ শাহ যুদ্ধ ও কৌশলের জোরে ছিন্নভিন্ন রাজ্যগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে আধুনিক নেপাল রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন।

এরপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শাহ রাজারা কখনো নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধারী শাসক, কখনো প্রতীকী রাজা হিসেবে টিকে ছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চাপ, অ্যাংলো-নেপাল যুদ্ধ কিংবা অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র—সবকিছু সামলাতে হয়েছে তাদের।

কিন্তু ২০০১ সালের রাজপ্রাসাদ হত্যাকাণ্ড রাজতন্ত্রের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয়। রাজা বীরেন্দ্র ও তার পরিবার নিহত হওয়ার পর জ্ঞানেন্দ্র সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তার ক্ষমতা ছিল বিতর্কিত এবং কঠোর দমননীতির কারণে রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন তীব্রতর হয়।

২০০৮ সালে ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ঘোষণার মধ্য দিয়ে ২৩৯ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে।

২০০৮ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত ১৭ বছরে নেপালে ১৪টি সরকার পরিবর্তিত হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক মন্দা মানুষকে হতাশ করেছে। ফলে রাজতন্ত্রের প্রতি নস্টালজিয়া এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

২০২৫ সালের মার্চে ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে বিক্ষোভ করেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তবে প্রতীকী রাজা চাওয়ার দাবি এবং পরম ক্ষমতাধারী রাজতন্ত্রের প্রত্যাশা যে ভিন্ন দুটি বিষয়—তা নিয়েও বিতর্ক আছে।

রাজতন্ত্রপন্থীরা যুক্তি দিচ্ছেন, প্রতীকী রাজা ঐক্য, স্থিতিশীলতা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক হতে পারেন। তবে সমালোচকরা মনে করেন, বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্নীতিগ্রস্ত কাঠামো যদি অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে প্রতীকী রাজা তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারবেন না।

অন্যদিকে, জেন-জিদের আন্দোলন আসলে ভবিষ্যৎমুখী—তাদের মূল দাবি দুর্নীতি দমন, বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা ও কর্মসংস্থানের সমাধান। তাদের কাছে রাজতন্ত্রে ফেরা মানে পশ্চাৎপদতার দিকে ফিরে যাওয়া।

👉 নেপাল আজ দাঁড়িয়ে আছে এক জটিল সন্ধিক্ষণে। একদিকে ব্যর্থ প্রজাতন্ত্রের বাস্তবতা, অন্যদিকে রাজতন্ত্রের নস্টালজিয়া। কিন্তু ভবিষ্যতের প্রশ্নে জেন-জিদের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট—তারা স্থিতিশীলতা চান, তবে সেটি রাজতন্ত্রের ছায়ায় নয়, বরং গণতন্ত্রের নতুন রূপে।