০১:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

হজরত বিলাল (রা.) : দাসত্ব থেকে ঈমানের আলোতে

হজরত বিলাল (রা.) ৫৮০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার সারাত এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা রাবাহ ছিলেন হাবশি বংশোদ্ভূত এক আরব ক্রীতদাস এবং মাতা হামামা ছিলেন আবসিনিয়ার এক রাজপরিবারের বংশধর, যিনি ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে দাসত্বে পতিত হন। জন্ম থেকেই বিলাল উমাইয়া ইবনে খালফের দাস হিসেবে বেড়ে ওঠেন। গায়ের রঙ ছিল গভীর কালো, এজন্য মক্কার সমাজ তাকে অবজ্ঞা করে ডাকত “ইবনুস সাওদা”—কালো মহিলার ছেলে।

শক্তিশালী দেহ, কঠোর পরিশ্রম আর অনুগত স্বভাবের কারণে বিলাল মনিবের বিশ্বস্ত দাসে পরিণত হলেও মক্কার সমাজে তিনি কোনো মর্যাদা পাননি। শ্বেতাঙ্গ কোরায়শরা কখনোই তাকে সমান চোখে দেখেনি।

এমন সময়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে মানুষকে ডেকে বললেন—“কোনো আরব অনারবের ওপরে শ্রেষ্ঠ নয়, কোনো শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গের ওপর প্রাধান্য রাখে না, তাকওয়া ছাড়া কারো কোনো মর্যাদা নেই।” সমতার এই অভাবনীয় বার্তা বিলালের অন্তরে আলোড়ন তোলে। দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধা জীবনে এই কথা তার কাছে মনে হলো মুক্তির পাথেয়। তিনি দ্বিধাহীনভাবে নবীজির হাতে শাহাদাতের কালিমা পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করলেন। ইসলামের ইতিহাসে তিনি নবম মুসলিম হিসেবে তালিকাভুক্ত হন।

কিন্তু ইসলাম গ্রহণের খবর যখন উমাইয়া ইবনে খালফ জানতে পারে, তখন শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন। বাতহা উপত্যকার প্রখর রোদে উত্তপ্ত বালির ওপর বিলালকে শুইয়ে বুকের ওপর বিশাল পাথর চাপানো হতো। শরীরের চামড়া ফেটে যেত, তবু তিনি অবিচল কণ্ঠে বলতেন—“আহাদুন আহাদ।” কখনো তাকে উটের পেছনে বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হতো, কখনো গলায় দড়ি বেঁধে মক্কার অলিগলিতে টানাহেঁচড়া করা হতো। উমাইয়ার দোসররা আগুনের অঙ্গার তার পিঠের নিচে রেখে জ্বলতে দিত। কিন্তু এসব নির্যাতনেও তিনি ঈমান থেকে একচুল বিচ্যুত হননি।

মুশরিকরা বারবার তাকে বলত—“মুহাম্মদকে ছেড়ে দাও, লাত-উজ্জার ধর্মে ফিরে আসো, তাহলে মুক্তি পাবে।” অথচ বিলালের উত্তর ছিল একটাই—“আহাদুন আহাদ।” প্রতিটি আঘাত, প্রতিটি শাস্তি তার ঈমানকে আরও দৃঢ় করে তুলেছিল। নির্যাতনের ভয়াবহতা দেখে মক্কার অন্য দাসরা ভীত হয়ে যেত, অথচ বিলালের মুখে ভেসে আসত একক ঈশ্বরের জয়গান।

এই অবিচলতা একদিন ইসলামের জন্য এক মহামূল্যবান অধ্যায়ে রূপ নেয়। ইতিহাসে বর্ণিত আছে, পরবর্তীতে হজরত আবু বকর (রা.) বিলালকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করেন। সেখান থেকে তিনি হয়ে ওঠেন ইসলামের অন্যতম সাহসী ও নির্ভীক যোদ্ধা। শুধু তাই নয়, নবীজির (সা.) নির্দেশে তিনি ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হিসেবে আজান দেয়ার মহাপদ লাভ করেন। তার কণ্ঠে উচ্চারিত “হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ” আজান মদিনার আকাশ-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতো।

হজরত বিলাল (রা.)-এর জীবনগাথা এক অবিস্মরণীয় শিক্ষা—কোনো বর্ণ, জাতি বা দাসত্ব মানুষের মর্যাদা নির্ধারণ করতে পারে না; আল্লাহর কাছে আসল মর্যাদা তাকওয়া ও ঈমানের। এক কালো ক্রীতদাস থেকে তিনি হয়ে ওঠেন ইসলামের প্রথমসারির সাহসী সৈনিক ও মুয়াজ্জিন। শত নির্যাতনের মাঝেও তার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল যে শব্দ—“আহাদুন আহাদ”—তা আজও মুসলিম উম্মাহকে ঈমানের অটলতার শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে।

ট্যাগ

শিক্ষা ভবনের সামনে সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

হজরত বিলাল (রা.) : দাসত্ব থেকে ঈমানের আলোতে

প্রকাশিত হয়েছে: ১২:৫৩:১৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

হজরত বিলাল (রা.) ৫৮০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার সারাত এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা রাবাহ ছিলেন হাবশি বংশোদ্ভূত এক আরব ক্রীতদাস এবং মাতা হামামা ছিলেন আবসিনিয়ার এক রাজপরিবারের বংশধর, যিনি ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে দাসত্বে পতিত হন। জন্ম থেকেই বিলাল উমাইয়া ইবনে খালফের দাস হিসেবে বেড়ে ওঠেন। গায়ের রঙ ছিল গভীর কালো, এজন্য মক্কার সমাজ তাকে অবজ্ঞা করে ডাকত “ইবনুস সাওদা”—কালো মহিলার ছেলে।

শক্তিশালী দেহ, কঠোর পরিশ্রম আর অনুগত স্বভাবের কারণে বিলাল মনিবের বিশ্বস্ত দাসে পরিণত হলেও মক্কার সমাজে তিনি কোনো মর্যাদা পাননি। শ্বেতাঙ্গ কোরায়শরা কখনোই তাকে সমান চোখে দেখেনি।

এমন সময়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে মানুষকে ডেকে বললেন—“কোনো আরব অনারবের ওপরে শ্রেষ্ঠ নয়, কোনো শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গের ওপর প্রাধান্য রাখে না, তাকওয়া ছাড়া কারো কোনো মর্যাদা নেই।” সমতার এই অভাবনীয় বার্তা বিলালের অন্তরে আলোড়ন তোলে। দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধা জীবনে এই কথা তার কাছে মনে হলো মুক্তির পাথেয়। তিনি দ্বিধাহীনভাবে নবীজির হাতে শাহাদাতের কালিমা পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করলেন। ইসলামের ইতিহাসে তিনি নবম মুসলিম হিসেবে তালিকাভুক্ত হন।

কিন্তু ইসলাম গ্রহণের খবর যখন উমাইয়া ইবনে খালফ জানতে পারে, তখন শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন। বাতহা উপত্যকার প্রখর রোদে উত্তপ্ত বালির ওপর বিলালকে শুইয়ে বুকের ওপর বিশাল পাথর চাপানো হতো। শরীরের চামড়া ফেটে যেত, তবু তিনি অবিচল কণ্ঠে বলতেন—“আহাদুন আহাদ।” কখনো তাকে উটের পেছনে বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হতো, কখনো গলায় দড়ি বেঁধে মক্কার অলিগলিতে টানাহেঁচড়া করা হতো। উমাইয়ার দোসররা আগুনের অঙ্গার তার পিঠের নিচে রেখে জ্বলতে দিত। কিন্তু এসব নির্যাতনেও তিনি ঈমান থেকে একচুল বিচ্যুত হননি।

মুশরিকরা বারবার তাকে বলত—“মুহাম্মদকে ছেড়ে দাও, লাত-উজ্জার ধর্মে ফিরে আসো, তাহলে মুক্তি পাবে।” অথচ বিলালের উত্তর ছিল একটাই—“আহাদুন আহাদ।” প্রতিটি আঘাত, প্রতিটি শাস্তি তার ঈমানকে আরও দৃঢ় করে তুলেছিল। নির্যাতনের ভয়াবহতা দেখে মক্কার অন্য দাসরা ভীত হয়ে যেত, অথচ বিলালের মুখে ভেসে আসত একক ঈশ্বরের জয়গান।

এই অবিচলতা একদিন ইসলামের জন্য এক মহামূল্যবান অধ্যায়ে রূপ নেয়। ইতিহাসে বর্ণিত আছে, পরবর্তীতে হজরত আবু বকর (রা.) বিলালকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করেন। সেখান থেকে তিনি হয়ে ওঠেন ইসলামের অন্যতম সাহসী ও নির্ভীক যোদ্ধা। শুধু তাই নয়, নবীজির (সা.) নির্দেশে তিনি ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হিসেবে আজান দেয়ার মহাপদ লাভ করেন। তার কণ্ঠে উচ্চারিত “হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ” আজান মদিনার আকাশ-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতো।

হজরত বিলাল (রা.)-এর জীবনগাথা এক অবিস্মরণীয় শিক্ষা—কোনো বর্ণ, জাতি বা দাসত্ব মানুষের মর্যাদা নির্ধারণ করতে পারে না; আল্লাহর কাছে আসল মর্যাদা তাকওয়া ও ঈমানের। এক কালো ক্রীতদাস থেকে তিনি হয়ে ওঠেন ইসলামের প্রথমসারির সাহসী সৈনিক ও মুয়াজ্জিন। শত নির্যাতনের মাঝেও তার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল যে শব্দ—“আহাদুন আহাদ”—তা আজও মুসলিম উম্মাহকে ঈমানের অটলতার শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে।