০১:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ঢাকায় প্রবেশের ৩টি পথ, যানজটে নাকাল যাত্রীরা

ঢাকায় প্রবেশের তিন দরজা: বৈষম্য, ভোগান্তি আর নীরব বিপর্যয়

ঢাকায় প্রবেশের প্রধান রাস্তা মাত্র তিনটি—গাবতলী, উত্তরা আর যাত্রাবাড়ি। দেশের ৬০টিরও বেশি জেলা থেকে রাজধানীতে ঢোকার জন্য কার্যকর বিকল্প রাস্তা নেই। অন্য যে প্রবেশপথগুলো রয়েছে, যেমন বাবুবাজার সেতু বা ৩০০ ফিট, সেগুলো কার্যত অচল। বাবুবাজার দিয়ে ঢুকতে পুরান ঢাকার যানজট পাড়ি দিতে অন্তত তিন ঘণ্টা লাগে। আর ৩০০ ফিট সরু রাস্তা দিয়ে ঢুকতে হয় প্রায় ১৫ কিলোমিটার বেশি ঘুরে। তাই কার্যত সব চাপ গিয়ে পড়ে এই তিন প্রবেশপথে।

উত্তরার রাস্তা: সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ, তবুও সুবিধা বেশি

উত্তরা দিয়ে মাত্র ৫ জেলার গাড়ি ঢাকায় আসে। কিন্তু এই প্রবেশপথে রয়েছে ৪ লেন মহাসড়ক, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), এবং একসাথে দুইটি এক্সপ্রেসওয়ে—ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আর আশুলিয়া-ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ে। ফলে ঢাকায় প্রবেশে এটি সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ রুট হলেও, অবকাঠামোগত সুবিধা এখানে সবচেয়ে বেশি।

গাবতলী: ১৮ জেলার চাপ, এক্সপ্রেসওয়ে নেই

গাবতলী দিয়ে ঢাকায় আসে ১৮ জেলার যানবাহন। এখানে আছে ৪ লেন মহাসড়ক, তবে কোনো এক্সপ্রেসওয়ে নেই। বিশেষ করে রাতের বেলায় এই রাস্তায় ভয়াবহ যানজট তৈরি হয়।

যাত্রাবাড়ি: ৪০ জেলার একমাত্র ভরসা, পৃথিবীর “অদ্ভুততম” প্রবেশপথ

সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র যাত্রাবাড়ি। দেশের ৪০ জেলার যানবাহন ঢাকায় ঢোকে এই পথ দিয়ে। চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৬ লেন, সিলেট মহাসড়কের ৪ লেন আর মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ৪ লেন—মোট ১৪ লেন সড়ক এসে একত্র হয় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে। অথচ ফ্লাইওভারটির কার্যকর এক্সিট মাত্র ১ লেন—চানখারপুল। গুলিস্তানের ২ লেন এক্সিট কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে হকারদের কারণে। ফলে ১৪ লেন মহাসড়কের চাপ গিয়ে পড়ে একটি সরু লেনে।

এখান থেকেই শুরু হয় ভয়াবহ যানজট। প্রতিদিন চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১২ কিলোমিটার, সিলেট মহাসড়কে ৬ কিলোমিটার আর মাওয়া মহাসড়কে ২ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। ঢাকায় ঢুকতে মাত্র ৫ কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিতে ৪০ জেলার যাত্রীদের বসে থাকতে হয় ন্যূনতম ৩ ঘণ্টা।

গণমাধ্যমের অন্ধকার দিক

প্রশ্ন আসতে পারে, এতো বড় সংকট আমরা জানি না কেন? উত্তর হলো—আমাদের গণমাধ্যমের ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা। বেশিরভাগ মিডিয়া হাউজ ও সাংবাদিক থাকেন উত্তর বা পশ্চিম ঢাকায়—মোহাম্মদপুর, বনানী, মিরপুর, খিলগাঁও বা নিকেতনে। যাত্রাবাড়ির যানজট পেরিয়ে প্রতিদিন অফিসে যাওয়া কার্যত অসম্ভব। ফলে রাজধানীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ি, যেখানে ঢাকার সবচেয়ে জনবহুল থানাগুলো অবস্থিত, কখনোই গণমাধ্যমের অগ্রাধিকার পায় না।

এমনকি রাজনৈতিক আন্দোলন-সংঘর্ষেও যাত্রাবাড়ি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, তা জাতীয় আলোচনায় আসে না। ৪০ জেলার মানুষের প্রতিদিনের ভোগান্তি থেকেও চোখ ফিরিয়ে নেয় মিডিয়া।

উন্নয়ন পরিকল্পনায় বৈষম্যের চিত্র

এই উদাহরণ দেখিয়ে বোঝা যায়—বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে পরিকল্পনা কতটা এলিট-কেন্দ্রিক এবং বৈষম্যমূলক। যেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ি, সেখানে কোনো কার্যকর সমাধান নেই। অন্যদিকে উত্তরার মতো কম গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথে একের পর এক এক্সপ্রেসওয়ে। এই বৈষম্যের কারণে প্রতিদিন কোটি কোটি ঘন্টা সময় অপচয় হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি ও মানুষের জীবনমান।

ট্যাগ

শিক্ষা ভবনের সামনে সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

ঢাকায় প্রবেশের ৩টি পথ, যানজটে নাকাল যাত্রীরা

প্রকাশিত হয়েছে: ০৭:১৬:৫২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ঢাকায় প্রবেশের তিন দরজা: বৈষম্য, ভোগান্তি আর নীরব বিপর্যয়

ঢাকায় প্রবেশের প্রধান রাস্তা মাত্র তিনটি—গাবতলী, উত্তরা আর যাত্রাবাড়ি। দেশের ৬০টিরও বেশি জেলা থেকে রাজধানীতে ঢোকার জন্য কার্যকর বিকল্প রাস্তা নেই। অন্য যে প্রবেশপথগুলো রয়েছে, যেমন বাবুবাজার সেতু বা ৩০০ ফিট, সেগুলো কার্যত অচল। বাবুবাজার দিয়ে ঢুকতে পুরান ঢাকার যানজট পাড়ি দিতে অন্তত তিন ঘণ্টা লাগে। আর ৩০০ ফিট সরু রাস্তা দিয়ে ঢুকতে হয় প্রায় ১৫ কিলোমিটার বেশি ঘুরে। তাই কার্যত সব চাপ গিয়ে পড়ে এই তিন প্রবেশপথে।

উত্তরার রাস্তা: সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ, তবুও সুবিধা বেশি

উত্তরা দিয়ে মাত্র ৫ জেলার গাড়ি ঢাকায় আসে। কিন্তু এই প্রবেশপথে রয়েছে ৪ লেন মহাসড়ক, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), এবং একসাথে দুইটি এক্সপ্রেসওয়ে—ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আর আশুলিয়া-ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ে। ফলে ঢাকায় প্রবেশে এটি সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ রুট হলেও, অবকাঠামোগত সুবিধা এখানে সবচেয়ে বেশি।

গাবতলী: ১৮ জেলার চাপ, এক্সপ্রেসওয়ে নেই

গাবতলী দিয়ে ঢাকায় আসে ১৮ জেলার যানবাহন। এখানে আছে ৪ লেন মহাসড়ক, তবে কোনো এক্সপ্রেসওয়ে নেই। বিশেষ করে রাতের বেলায় এই রাস্তায় ভয়াবহ যানজট তৈরি হয়।

যাত্রাবাড়ি: ৪০ জেলার একমাত্র ভরসা, পৃথিবীর “অদ্ভুততম” প্রবেশপথ

সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র যাত্রাবাড়ি। দেশের ৪০ জেলার যানবাহন ঢাকায় ঢোকে এই পথ দিয়ে। চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৬ লেন, সিলেট মহাসড়কের ৪ লেন আর মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ৪ লেন—মোট ১৪ লেন সড়ক এসে একত্র হয় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে। অথচ ফ্লাইওভারটির কার্যকর এক্সিট মাত্র ১ লেন—চানখারপুল। গুলিস্তানের ২ লেন এক্সিট কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে হকারদের কারণে। ফলে ১৪ লেন মহাসড়কের চাপ গিয়ে পড়ে একটি সরু লেনে।

এখান থেকেই শুরু হয় ভয়াবহ যানজট। প্রতিদিন চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১২ কিলোমিটার, সিলেট মহাসড়কে ৬ কিলোমিটার আর মাওয়া মহাসড়কে ২ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। ঢাকায় ঢুকতে মাত্র ৫ কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিতে ৪০ জেলার যাত্রীদের বসে থাকতে হয় ন্যূনতম ৩ ঘণ্টা।

গণমাধ্যমের অন্ধকার দিক

প্রশ্ন আসতে পারে, এতো বড় সংকট আমরা জানি না কেন? উত্তর হলো—আমাদের গণমাধ্যমের ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা। বেশিরভাগ মিডিয়া হাউজ ও সাংবাদিক থাকেন উত্তর বা পশ্চিম ঢাকায়—মোহাম্মদপুর, বনানী, মিরপুর, খিলগাঁও বা নিকেতনে। যাত্রাবাড়ির যানজট পেরিয়ে প্রতিদিন অফিসে যাওয়া কার্যত অসম্ভব। ফলে রাজধানীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ি, যেখানে ঢাকার সবচেয়ে জনবহুল থানাগুলো অবস্থিত, কখনোই গণমাধ্যমের অগ্রাধিকার পায় না।

এমনকি রাজনৈতিক আন্দোলন-সংঘর্ষেও যাত্রাবাড়ি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, তা জাতীয় আলোচনায় আসে না। ৪০ জেলার মানুষের প্রতিদিনের ভোগান্তি থেকেও চোখ ফিরিয়ে নেয় মিডিয়া।

উন্নয়ন পরিকল্পনায় বৈষম্যের চিত্র

এই উদাহরণ দেখিয়ে বোঝা যায়—বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে পরিকল্পনা কতটা এলিট-কেন্দ্রিক এবং বৈষম্যমূলক। যেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ি, সেখানে কোনো কার্যকর সমাধান নেই। অন্যদিকে উত্তরার মতো কম গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথে একের পর এক এক্সপ্রেসওয়ে। এই বৈষম্যের কারণে প্রতিদিন কোটি কোটি ঘন্টা সময় অপচয় হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি ও মানুষের জীবনমান।