আল-হাসীব (الحسيب) আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম, যার অর্থ ‘হিসাব গ্রহণকারী’ বা ‘যিনি সমস্ত কিছুর হিসাব রাখেন’। আল্লাহ তা’আলা এই নামের মাধ্যমে তাঁর অসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দ্বারা বান্দাদের সব ভালো-মন্দ কাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব গ্রহণ করেন এবং সে অনুযায়ী প্রতিদান দেন, বিশেষ করে কিয়ামতের দিন, যখন তিনি একমাত্র বিচারক হবেন।

পৃথিবীর জীবনে চলার পথে হঠাৎ আপনার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। হাসিমুখে সালাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন, কিছুক্ষণ আলাপ করে জানতে পারলেন বন্ধুটি বিপদে পড়েছে। আপনি ছোট্ট একটি সুপরামর্শ দিলেন, খুবই সামান্য একটি উপকার। কিন্তু কিয়ামতের দিন সেই হাসিমুখ, সেই সালাম আর সেই সুপরামর্শের জন্য আপনার সওয়াবের পাল্লা এত ভারী হবে যে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। আল্লাহর ‘আল-হাসীব’ নামের মাহাত্ম্য এখানেই যে, তিনি এমন ক্ষুদ্রতম আমলও হিসাবের খাতায় অন্তর্ভুক্ত করেন। যেমনটি কুরআনে বলা হয়েছে, ‘সুতরাং যে অণু পরিমাণ ভালো কাজ করবে সে তা দেখতে পাবে, আর যে অণু পরিমাণ মন্দ করবে সে তা দেখতে পাবে।’ (সুরা যিলযাল, আয়াত: ৭-৮)।

আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসার দৃষ্টান্ত হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনে সুস্পষ্ট। ষোলো বছরের কিশোর বয়সে তাঁকে বিশাল আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, কারণ তিনি মুশরিক সমাজের মিথ্যা ধর্মবিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। আগুনে নিক্ষেপের আগে তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘হাসবিয়াল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল’ অর্থাৎ ‘আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম অভিভাবক।’ তখন আল্লাহ আগুনকে নির্দেশ দিলেন, ‘হে আগুন! তুমি ইবরাহিমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৬৯)। সেই মুহূর্তে পৃথিবীর সমস্ত আগুন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল, যেমনটি তাফসির ইবনে কাসিরে উল্লেখ রয়েছে। এখানেই আল্লাহর ‘আল-হাসীব’ নামের আরেক দিক প্রকাশ পায়—তিনি তাঁর বান্দার ওপর পূর্ণ খেয়াল রাখেন, রক্ষা করেন, যথেষ্ট হয়ে ওঠেন।

যেমন কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে, আল্লাহ তাঁর জন্য যথেষ্ট।’ (সুরা তালাক, আয়াত: ৩)। রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবিরাও যখন শত্রুর খবর শুনে চিন্তিত হয়েছিলেন, তখন তাঁরাও পাঠ করেছিলেন, ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল’। ‘আল-হাসীব’ মানে শুধু হিসাব গ্রহণকারী নন, বরং তিনিই সেই সত্তা যিনি বান্দার জীবনের প্রতিটি দিক পর্যবেক্ষণ করেন, প্রতিটি আমলের ফল দেন, এবং দুনিয়া ও আখিরাতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন। কুরআনের ভাষায়, ‘আমি কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদণ্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারও প্রতি জুলুম হবে না। যদি কোনো আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করব, আর হিসাব গ্রহণের জন্য আমিই যথেষ্ট।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৪৭)।

আল্লাহর এই নামটি আমাদের শেখায় আত্মসমালোচনা, সততা ও দায়িত্ববোধ। সুরা ইসরার ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘পাঠ করো তোমার কিতাব, আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব-নিকাশের জন্য যথেষ্ট।’ তাই প্রতিদিনের শেষে নিজের হিসাব নিজে নেওয়া উচিত, কারণ আল্লাহ হচ্ছেন ‘সারিউল হিসাব’—অর্থাৎ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।

লেনদেন, সম্পর্ক ও দায়িত্ব পালনে সততা বজায় রাখা, প্রতিটি আমলে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা এবং আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা রাখা—এই হলো ‘আল-হাসীব’ নামের শিক্ষা। সকাল-সন্ধ্যার আমলে সুরা তওবার ১২৯ নম্বর আয়াতটি পাঠ করা অত্যন্ত উপকারী—‘হাসবি আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়া আলাইহি তাওয়াক্কালতু ওয়া হুয়া রাব্বুল আরশিল আজিম।’ অর্থাৎ, ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। আমি তাঁরই ওপর নির্ভর করি। তিনি মহা আরশের অধিপতি।’

যে ব্যক্তি ‘আল-হাসীব’-এর ওপর তাওয়াক্কুল করে, সে দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর সাহায্য ও সন্তুষ্টি লাভ করে।