
ইসরায়েলি আগ্রাসনের পর দক্ষিণ থেকে হাজারো মানুষের উত্তরমুখী যাত্রা, ঘরে ফেরার পথে ক্ষুধা, ক্লান্তি আর হতাশার ছাপ
গাজা সিটিতে ফিরে এসেছেন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি, যেখানে একসময় জীবনের স্পন্দন ছিল, এখন সেটি কেবল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলি আগ্রাসনের ভয়াবহতায় শহর ছাড়তে বাধ্য হওয়া এসব মানুষ কয়েক সপ্তাহ পর দক্ষিণ গাজা থেকে উত্তরমুখে ফিরছেন, অনেকেই ২০ কিলোমিটারের বেশি পথ হেঁটে।
ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, উপকূলীয় ক্ষতিগ্রস্ত সরু সড়ক ধরে হাজারো মানুষ হাঁটছেন। কারও হাতে ফিলিস্তিনের পতাকা, কেউ বিজয়ের চিহ্ন দেখাচ্ছেন—তবুও মুখে ক্লান্তি ও অনাহারের ছাপ স্পষ্ট। অনেকে পিঠে বয়ে এনেছেন সামান্য অবশিষ্ট জিনিসপত্র, কেউ বা খচ্চরের গাড়ি কিংবা ছোট ট্রাক ভাড়া করেছেন অতিরিক্ত দামে।
গাজার শিক্ষক আলা সালেহ বলেন, “রাস্তা দীর্ঘ ও কঠিন, খাবার বা পানি কিছুই নেই। গাড়ি ভাড়া করতে গেলে লাগে প্রায় ৪,০০০ শেকেল, যা অধিকাংশের সামর্থ্যের বাইরে।” তিনি জানান, নিরাপত্তার নয়, হতাশার তাড়নাতেই মানুষ ফিরছে ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরে।
ইসরায়েলি বাহিনীর বিমান হামলা ও স্থল অভিযানে প্রায় ৭ লাখ মানুষ গাজা সিটি ও উত্তরাঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত হন। গাজা সিটিকে “হামাসের শেষ ঘাঁটি” আখ্যা দিয়ে ইসরায়েলি সেনারা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময় চুক্তির অংশ হিসেবে সেনা প্রত্যাহারের পর উত্তর ও পশ্চিম গাজায় প্রবেশ করে হতবাক হয়ে যায় স্থানীয়রা।
শেখ রিদওয়ান, কারামা ও বীচ ক্যাম্প এলাকায় দেখা গেছে—সম্পূর্ণ আবাসিক ব্লক মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, শত শত বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে, অবকাঠামোও নিশ্চিহ্ন। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোয় মানুষদের দেখা গেছে ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে হাঁটতে, নিজেদের এলাকা খুঁজে দেখতে। এক ব্যক্তি ভিডিওতে বলছেন, “ইসরায়েলি সেনারা এখনো কাছেই আছে। দেখুন কী ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ—তারা সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে।”
দক্ষিণ ও পূর্ব গাজার সাবরা ও জাইতুন এলাকাতেও একই চিত্র—ধসে পড়া ভবন সারি সারি, নিশ্চিহ্ন জনপদ। ধ্বংসস্তূপের নিচে লাশ উদ্ধারে কাজ করছে হামাসের গাজা সিভিল ডিফেন্স দল। সংস্থার মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল জানান, শুক্রবার সকালে উত্তর গাজা থেকে আটটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, আরও বহু মানুষ এখনো নিখোঁজ।
মাইনস অ্যাডভাইজরি গ্রুপ (MAG) জানিয়েছে, ধ্বংসস্তূপে বিপুল পরিমাণ অবিস্ফোরিত গোলাবারুদ (UXO) থেকে গেছে, যা মানুষের ফেরার পথে নতুন হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
একসময় প্রাণচঞ্চল গাজার সাগরতট এখন পরিণত হয়েছে তাঁবুর সারিতে। পরিবারগুলো ভাঙা কংক্রিটের করিডর পেরিয়ে ফিরছে ঘরে, যদিও অনেকেরই আর ঘর অবশিষ্ট নেই।
শিক্ষক আলা সালেহ বলেন, “আমার বাড়ি এক বছর আগে ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি ধ্বংসস্তূপের ওপরই তাঁবু ফেলব। আমরা শুধু পুনর্গঠন করতে চাই—ক্লান্ত এই জীবনে একটু নিরাপত্তা চাই।”
জাবালিয়ার বাসিন্দা ওয়েল আল-নাজ্জার জানান, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি তিনবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। যুদ্ধবিরতির খবর পেয়ে তিনি ফিরে যাচ্ছেন ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িতে।
“বাড়ি যদি ধ্বংস হয়ে যায়, ধ্বংসস্তূপই যদি থাকে—তবুও আমরা ফিরে যাব, সেখানে তাঁবু ফেলব, আমাদের মানুষের কাছে ফিরে যাব,” বলেন তিনি।
সূত্র: বিবিসি