ভারতে সাম্প্রতিক এক মাসে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নতুন ঢেউয়ের দমন–পীড়ন শুরু হয়েছে। কারণ—তারা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)–এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে ‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’ লেখা পোস্টার, ব্যানার বা টি-শার্ট ব্যবহার করেছেন। বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে এই বাক্যকে এখন ‘আইনশৃঙ্খলার হুমকি’ হিসেবে দেখছে পুলিশ।
অলাভজনক সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব সিভিল রাইটস (এপিসিআর) জানায়, এখন পর্যন্ত অন্তত ২২টি মামলা হয়েছে এবং আড়াই হাজারের বেশি মুসলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, অনেকের বাড়িঘরও বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত ৪ সেপ্টেম্বর, ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুরে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে আয়োজিত শোভাযাত্রা থেকে। মুসলিমরা সেখানে ‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’ লেখা আলোকসজ্জা বোর্ড টাঙান। স্থানীয় কিছু হিন্দু তা “আইনবিরুদ্ধ নতুন উপাদান” বলে অভিযোগ করলে পুলিশ দ্রুত ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে।
অভিযোগের ধারা ছিল “ধর্মীয় বিদ্বেষ উসকে দেওয়া” এবং “আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন করা”—যার সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড।
ঘটনার পর উত্তর প্রদেশের বাইরে তেলেঙ্গানা, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, উত্তরাখণ্ড, জম্মু–কাশ্মীরসহ বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিম তরুণরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও পোশাকে “আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)” বার্তা ব্যবহার করে প্রতিবাদ জানান।
২৬ সেপ্টেম্বর কানপুর থেকে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার দূরের বেরেলি শহরে স্থানীয় ইমাম তৌকির রেজা বিক্ষোভের ডাক দেন। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের তীব্র সংঘর্ষ হয়। পরে পুলিশ ৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করে, এবং ইমামসহ তাঁর আত্মীয়দের আটক করে।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া কয়েকজনের বাড়ি ও দোকান বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করে প্রশাসন।
মানবাধিকারকর্মীদের ভাষ্য, ভারতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুসলিমদের বাড়িঘর বিনা নোটিশে ভেঙে ফেলার ঘটনা বেড়েছে। সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, আদালতের আদেশ ছাড়া কারও বাড়ি ধ্বংস করা যাবে না। কিন্তু মাঠপর্যায়ে এই নির্দেশনা প্রায়ই উপেক্ষা করা হচ্ছে।
পুলিশ বলছে, “আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)” লেখা বা পোস্ট করায় “ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়ানোর আশঙ্কা” তৈরি হয়েছে। কিন্তু মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এটি সম্পূর্ণভাবে ভারতের সংবিধানের ২৫ ও ১৯ ধারার লঙ্ঘন।
এই ধারাগুলো নাগরিকের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করে—যতক্ষণ না তা ঘৃণা বা সহিংসতা উসকে দেয়।
এপিসিআরের জাতীয় সমন্বয়ক নাদিম খান বলেন, “কর্তৃপক্ষ জানে—‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’ বলা অপরাধ নয়। তাই সরাসরি নয়, বরং বিকল্প আইনে মুসলিমদের ফাঁসানো হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “ভারতের সর্বত্র হিন্দু দেবতাদের হাতে অস্ত্রসহ ছবি দেখা যায়। যদি এগুলো মুসলিমদের জন্য হুমকি না হয়, তবে নবীপ্রেমও কেন অপরাধ?”
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান আকার প্যাটেল বলেন, “‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’-এর মতো শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশকে অপরাধ বানানো ভারতের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পরিপন্থী।”
তিনি যোগ করেন, “রাষ্ট্রের কাজ অধিকার রক্ষা করা, কারও বিশ্বাসের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা নয়।” বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতে গণতান্ত্রিক সূচক ও ধর্মীয় সহনশীলতার অবনতি ঘটছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্য ও সহিংসতার ঘটনা বছরে বছরে বেড়েই চলেছে।
২০২৩ সালে এমন ঘটনার সংখ্যা ছিল ৬৬৮টি, আর ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,১৬৫টি—অর্থাৎ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৭৪ শতাংশ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসিম আলি বলেন, “স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম বিরোধ এখন জাতীয় রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। মুসলিমদের ধর্মীয় পরিচয়ের যেকোনো প্রকাশকে উসকানিমূলক অপরাধ হিসেবে দেখানো হচ্ছে।” তিনি জানান, কানপুর ঘটনার পর মোদির নির্বাচনী এলাকা বারানসীতে বিজেপি নেতারা ‘আই লাভ বুলডোজার’ লেখা পোস্টার টাঙিয়েছেন—যা মুসলিমদের ওপর দমননীতিকে আরও উৎসাহিত করছে।
ভারতের সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু আজ সেই অধিকারই মুসলিমদের জন্য ঝুঁকিতে।
‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’ লেখা শুধু ভালোবাসার প্রকাশ নয়—এটি এখন ভারতের গণতন্ত্র ও সহনশীলতার এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাও হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রকাশক ও সম্পাদক
© কপিরাইট সমাচার বিশ্ব ২০২৫ | আমাদের ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।