নানা অনিশ্চয়তা, উত্তেজনা ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত সই হলো নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল ‘জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’। শুক্রবার বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। দীর্ঘ কয়েক মাসের আলোচনা শেষে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাবকে ভিত্তি করে এই সনদ তৈরি করা হয়। এতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ২৪টি রাজনৈতিক দল ও জোট স্বাক্ষর করে।
তবে আলোচিত জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা তরুণদের গড়া দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অনুষ্ঠানে অংশ নেয়নি এবং সনদে সইও করেনি। একইভাবে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদও সনদ থেকে বিরত থাকে। এছাড়া গণফোরাম উপস্থিত থাকলেও শেষ পর্যন্ত সনদে সই করেনি। ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, ইচ্ছা করলে পরবর্তীতেও দলগুলো এই সনদে স্বাক্ষর করতে পারবে
শুক্রবার দুপুরে অনুষ্ঠানের কিছুক্ষণ আগে ‘জুলাই যোদ্ধা’ পরিচয়ে একদল তরুণ সংসদ এলাকার দক্ষিণ প্লাজায় অবস্থান নেয়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে তাদের সরিয়ে দেয়। একপর্যায়ে আশপাশের এলাকায় সংঘর্ষ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। এ সময় সরকারের কিছু উপদেষ্টা অনুষ্ঠান স্থগিতের পরামর্শ দিলেও অধ্যাপক ইউনূস দৃঢ় অবস্থান নেন অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় শুরু হয় জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজসহ কমিশনের অন্যান্য সদস্যরা। অনুষ্ঠানে বিএনসিসি ও স্কাউট সদস্যরা কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করে অতিথিদের স্বাগত জানান। বিকেল পাঁচটার দিকে কমিশনের সদস্য ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি সনদের অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেন। সবার শেষে সই করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস
স্বাক্ষর শেষে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ভাষণে বলেন, “আজ আমাদের নবজন্ম হলো। এই স্বাক্ষরের মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশের সূচনা করলাম।” তিনি তরুণ প্রজন্মের প্রতি গভীর আস্থা প্রকাশ করে বলেন, “যেই তরুণেরা এই পরিবর্তনের পথ তৈরি করেছে, তারাই বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়ে তুলবে।”
তিনি রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে আহ্বান জানান— “আপনারা সবাই বসে একটি নির্বাচন সনদ তৈরি করুন, এমনভাবে নির্বাচন করুন যেন পৃথিবীর কেউ বলতে না পারে, এখানে কোনো অন্যায় হয়েছে।” ইউনূস আশা প্রকাশ করেন, ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচন হবে, তা বিশ্বের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হবে।
স্বাগত বক্তব্যে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “আজকের দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব সময়। আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি এবং এই সনদ আমাদের নতুন যাত্রার মাইলফলক।” তিনি আরও বলেন, “আমরা ভয়ে ভয়ে শুরু করেছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐক্যের মাধ্যমে এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে।”
অনুষ্ঠানে তিন বাহিনীর প্রধান— সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান—সহ উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, মন্ত্রীপর্যায়ের উপদেষ্টা, সচিব ও বিশিষ্ট নাগরিকরা। অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীসহ অনেকে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
জুলাই সনদের মূল লক্ষ্য রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে গণতান্ত্রিক সংস্কার আনা। কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই মাসের মধ্যেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ দেবে, যাতে গণভোটের ভিত্তি, সময়সূচি ও বাস্তবায়ন কাঠামো উল্লেখ থাকবে।
অনুষ্ঠানের শেষে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমরা সবাই মিলে আজ যে ঐক্যের সুর তুলেছি, সেই সুর নিয়েই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পথে যাব। ঐক্যের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।” তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, জুলাই সনদের এই ঐক্য ও অঙ্গীকারই হবে দেশের নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা।
প্রকাশক ও সম্পাদক
© কপিরাইট সমাচার বিশ্ব ২০২৫ | আমাদের ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।