
আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের জন্য রহমত ও ক্ষমার দরজা সর্বদা উন্মুক্ত রেখেছেন। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ বারবার আহ্বান করেছেন যাতে মানুষ নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, কারণ আল্লাহই একমাত্র যিনি সব গুনাহ ক্ষমা করেন। সূরা নূহে আল্লাহ বলেন— “আমি বলেছি, তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও, তিনি তো মহান ক্ষমাশীল। তোমরা ক্ষমা চাইলে তিনি তোমাদের উপর অজস্র ধারায় বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি বৃদ্ধি করবেন, তোমাদের জন্য বাগান সৃষ্টি করবেন এবং তোমাদের জন্য নদী প্রবাহিত করবেন।” (সূরা নূহ ৭১:১০-১২)। আবার সূরা আলে ইমরানে আল্লাহ বলেন— “যারা কোনো পাপ করে ফেললে কিংবা নিজেদের প্রতি জুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, আর আল্লাহ ব্যতীত কে আছে যে পাপ ক্ষমা করতে পারে?” (সূরা আলে ইমরান ৩:১৩৫)। এই আয়াতগুলো স্পষ্ট প্রমাণ করে, যে বান্দা আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে ফিরে আসে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে, তার জন্য আল্লাহর রহমত অবধারিত।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজে প্রতিদিন অসংখ্যবার ইস্তিগফার করতেন এবং সাহাবাদেরও এর প্রতি উৎসাহ দিতেন। সহিহ বুখারীর ৬৩০৬ নম্বর হাদীসে শাদ্দাদ ইবনু আউস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন— “সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার”, অর্থাৎ ক্ষমা প্রার্থনার শ্রেষ্ঠ দোয়া, হলো এই দোয়া: اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي، لَا إِلٰهَ إِلَّا أَنْتَ، خَلَقْتَنِي، وَأَنَا عَبْدُكَ، وَأَنَا عَلٰى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ، أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ، وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي، فَاغْفِرْ لِي، فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ। এর অর্থ হলো— “হে আল্লাহ! তুমি আমার প্রতিপালক, তোমা ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ, আমি তোমার দাস। আমি যথাসাধ্য তোমার সঙ্গে করা অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতিতে অবিচল আছি। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে তোমার আশ্রয় চাই। তোমার দান করা অনুগ্রহ আমি স্বীকার করছি, আর আমার গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। তুমি আমাকে ক্ষমা কর, কারণ তুমি ছাড়া কেউই পাপ ক্ষমা করতে পারে না।”
নবী করিম (সা.) আরও বলেন— “যে ব্যক্তি সকালে দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এই দোয়া পাঠ করবে, এবং সন্ধ্যা হওয়ার আগেই মারা যাবে, সে জান্নাতী হবে। আর যে ব্যক্তি রাতে দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এই দোয়া পাঠ করবে, এবং সকাল হওয়ার আগেই মারা যাবে, সেও জান্নাতী হবে।” (সহিহ বুখারী)। অর্থাৎ এই দোয়া পড়া ব্যক্তির জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে যদি সে ঈমানের সঙ্গে, অন্তর থেকে এই ইস্তিগফার উচ্চারণ করে।
ইস্তিগফার শুধু গুনাহ মাফের মাধ্যম নয়; এটি রিযিক, সন্তান, শান্তি ও জীবনের বরকতের অন্যতম চাবিকাঠি। সূরা নূহের আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে ইস্তিগফার করলে আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি পাঠাবেন, সম্পদ ও সন্তান বৃদ্ধি করবেন এবং জীবনে প্রশান্তি দান করবেন। ইমাম হাসান বসরী (রহ.) বলেছেন— “যে ব্যক্তি দারিদ্র্যে ভুগবে, সন্তান কামনা করবে বা জীবনের কোনো সংকটে পড়বে, সে যেন ইস্তিগফার বাড়িয়ে দেয়; আল্লাহ তার সব প্রয়োজন পূরণ করবেন।”
সাইয়্যিদুল ইস্তিগফারকে বলা হয় ইস্তিগফারের রাজা, কারণ এটি এমন এক দোয়া যাতে বান্দা একদিকে আল্লাহর একত্ব ও সৃষ্টিকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, অন্যদিকে নিজের অক্ষমতা ও অপরাধের স্বীকারোক্তি জানায়। এতে কৃতজ্ঞতা, তাওবা, বিনয়, ঈমান এবং ভরসা— সবকিছুর এক অপূর্ব সমন্বয় রয়েছে। আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা শুধু মুখের কথা নয়; এটি আত্মার এক আর্তনাদ, যা বান্দাকে গুনাহ থেকে দূরে রাখে এবং আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে যায়।
নবী করিম (সা.) নিজে বলেছেন, “আমি প্রতিদিন সত্তরবারেরও বেশি ইস্তিগফার করি।” এর মাধ্যমে তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যে কোনো মানুষই গুনাহমুক্ত নয়, তবে ইস্তিগফারই হলো সেই পথ যা মানুষকে শুদ্ধ করে, আত্মাকে পবিত্র করে এবং আল্লাহর রহমতের যোগ্য করে তোলে। তাই মুসলমানদের উচিত প্রতিদিন সকালে ও রাতে অন্তত একবার এই সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার পাঠ করা, যেন আল্লাহর ক্ষমা ও জান্নাতের প্রতিশ্রুতি অর্জন করা যায়।
ইস্তিগফার কেবল পাপ মোচনের জন্য নয়, এটি বান্দা ও রবের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের প্রতীক। যে হৃদয় ইস্তিগফারে ব্যস্ত থাকে, সেখানে ভয়, দুঃখ বা হতাশার স্থান থাকে না। কারণ সে জানে, আল্লাহ সবকিছু ক্ষমা করতে পারেন, যদি বান্দা আন্তরিকভাবে ফিরে আসে। এই দোয়া তাই শুধু শব্দ নয়— এটি জান্নাতের চাবি, দয়ার আহ্বান এবং শান্ত আত্মার পথনির্দেশ।