১১:০৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ৩০ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘বন্ধুত্বের হাত’ বাড়ালেন ট্রাম্প, তেহরানের প্রতিক্রিয়া কী?

  • গাজায় দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধের সমাপ্তির পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি বড় সংকটে নজর দিচ্ছেন— তা হলো তেহরান–ওয়াশিংটন সম্পর্কের দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন। ইসরায়েল সফরে গিয়ে ট্রাম্প সোমবার ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য এক নতুন চুক্তির জন্য ‘বন্ধুত্বের হাত’ বাড়াতে প্রস্তুত।

ইসরায়েলি পার্লামেন্ট নেসেটে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প বলেন, “আমরা প্রস্তুত, যখন তোমরাও প্রস্তুত হবে। এটি হবে ইরানের জন্য সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। আমি বলছি, তারা একটি চুক্তি করতে চায়— যদি তা হয়, তা হবে দারুণ।”

তবে তাঁর এই শান্তিপূর্ণ বার্তার আড়ালে রয়েছে কঠোর বাস্তবতা। বছরের মাঝামাঝি সময়ে ১২ দিনের ইরান–ইসরায়েল যুদ্ধ চলাকালে ট্রাম্প প্রশাসন প্রথমবারের মতো তেহরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সরাসরি বোমাবর্ষণ করে। ফলে দুই দেশের সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে ওঠে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কুইন্সি ইনস্টিটিউটের সহসভাপতি ত্রিতা পারসি বলেন, “ইরানে এখন এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র কূটনীতির কথা বলে আসলে তাদের নিরাপত্তাবোধ দুর্বল করতে চায়।”
তিনি মনে করেন, জুন মাসে তেহরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র–ইসরায়েলের যৌথ হামলা দেশটির অভ্যন্তরে কূটনীতিপন্থী গোষ্ঠীর অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়েছে।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি সাম্প্রতিক এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যুক্তিসংগত, ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায্য কোনো প্রস্তাব পাই, তা অবশ্যই বিবেচনা করব।”
তবে তেহরান এখনো কোনো নতুন আলোচনায় আগ্রহ দেখায়নি। তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা এবং সামরিক হামলার দায় চাপিয়েছে।

নতুন চুক্তি নিয়ে আলোচনায় বাধা সৃষ্টি করছে ওয়াশিংটনের ‘শূন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ’ দাবি। ২০১৮ সালে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে করা পারমাণবিক চুক্তি (জেসিপিওএ) থেকে সরে গিয়েছিল। এবার নতুন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ইরানকে সম্পূর্ণভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করতে হবে।

তেহরান এই দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের বক্তব্য, “পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) কোনো দেশের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নিষিদ্ধ করে না।”

জাতিসংঘের পারমাণবিক সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, ইরানের কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দেশটি কয়েক মাসের মধ্যেই পুনরায় কার্যক্রম শুরু করতে সক্ষম হবে।

ইরানবিষয়ক বিশ্লেষক গ্রেগরি ব্রিউ বলেন, “ট্রাম্প হয়তো কূটনীতির কথা বলছেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি সময় নিচ্ছেন। ইরান এখন দুর্বল; তাই চাপ বাড়াতে চাইছেন ট্রাম্প।”
তিনি আরও বলেন, “ট্রাম্প চান ইরান নিজেরাই আলোচনায় ফেরার জন্য বাধ্য হোক। অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ বাড়িয়ে তিনি সেটিই নিশ্চিত করতে চাইছেন।”

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর কোনো আস্থা রাখার সুযোগ নেই। গাজা যুদ্ধ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও সামরিক হামলার মধ্যেও তেহরান বলেছে, “আমরা পারমাণবিক অস্ত্র চাই না— তবে সার্বভৌম অধিকার ছাড়ব না।”

ট্রাম্পের বক্তব্যে আপাত শান্তি ও কূটনীতির বার্তা থাকলেও, বাস্তবে ইরান–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এখনো গভীর অবিশ্বাসে আচ্ছন্ন। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ, নিষেধাজ্ঞা, এবং আঞ্চলিক রাজনীতির জটিলতায় এই ‘বন্ধুত্বের হাত’ সত্যিই চুক্তিতে রূপ নেবে কি না, তা এখনো সময়ের অপেক্ষা।

ট্যাগ

‘বন্ধুত্বের হাত’ বাড়ালেন ট্রাম্প, তেহরানের প্রতিক্রিয়া কী?

প্রকাশিত হয়েছে: ০১:০৩:২১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
  • গাজায় দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধের সমাপ্তির পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি বড় সংকটে নজর দিচ্ছেন— তা হলো তেহরান–ওয়াশিংটন সম্পর্কের দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন। ইসরায়েল সফরে গিয়ে ট্রাম্প সোমবার ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য এক নতুন চুক্তির জন্য ‘বন্ধুত্বের হাত’ বাড়াতে প্রস্তুত।

ইসরায়েলি পার্লামেন্ট নেসেটে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প বলেন, “আমরা প্রস্তুত, যখন তোমরাও প্রস্তুত হবে। এটি হবে ইরানের জন্য সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। আমি বলছি, তারা একটি চুক্তি করতে চায়— যদি তা হয়, তা হবে দারুণ।”

তবে তাঁর এই শান্তিপূর্ণ বার্তার আড়ালে রয়েছে কঠোর বাস্তবতা। বছরের মাঝামাঝি সময়ে ১২ দিনের ইরান–ইসরায়েল যুদ্ধ চলাকালে ট্রাম্প প্রশাসন প্রথমবারের মতো তেহরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সরাসরি বোমাবর্ষণ করে। ফলে দুই দেশের সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে ওঠে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কুইন্সি ইনস্টিটিউটের সহসভাপতি ত্রিতা পারসি বলেন, “ইরানে এখন এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র কূটনীতির কথা বলে আসলে তাদের নিরাপত্তাবোধ দুর্বল করতে চায়।”
তিনি মনে করেন, জুন মাসে তেহরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র–ইসরায়েলের যৌথ হামলা দেশটির অভ্যন্তরে কূটনীতিপন্থী গোষ্ঠীর অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়েছে।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি সাম্প্রতিক এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যুক্তিসংগত, ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায্য কোনো প্রস্তাব পাই, তা অবশ্যই বিবেচনা করব।”
তবে তেহরান এখনো কোনো নতুন আলোচনায় আগ্রহ দেখায়নি। তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা এবং সামরিক হামলার দায় চাপিয়েছে।

নতুন চুক্তি নিয়ে আলোচনায় বাধা সৃষ্টি করছে ওয়াশিংটনের ‘শূন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ’ দাবি। ২০১৮ সালে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে করা পারমাণবিক চুক্তি (জেসিপিওএ) থেকে সরে গিয়েছিল। এবার নতুন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ইরানকে সম্পূর্ণভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করতে হবে।

তেহরান এই দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের বক্তব্য, “পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) কোনো দেশের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নিষিদ্ধ করে না।”

জাতিসংঘের পারমাণবিক সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, ইরানের কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দেশটি কয়েক মাসের মধ্যেই পুনরায় কার্যক্রম শুরু করতে সক্ষম হবে।

ইরানবিষয়ক বিশ্লেষক গ্রেগরি ব্রিউ বলেন, “ট্রাম্প হয়তো কূটনীতির কথা বলছেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি সময় নিচ্ছেন। ইরান এখন দুর্বল; তাই চাপ বাড়াতে চাইছেন ট্রাম্প।”
তিনি আরও বলেন, “ট্রাম্প চান ইরান নিজেরাই আলোচনায় ফেরার জন্য বাধ্য হোক। অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ বাড়িয়ে তিনি সেটিই নিশ্চিত করতে চাইছেন।”

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর কোনো আস্থা রাখার সুযোগ নেই। গাজা যুদ্ধ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও সামরিক হামলার মধ্যেও তেহরান বলেছে, “আমরা পারমাণবিক অস্ত্র চাই না— তবে সার্বভৌম অধিকার ছাড়ব না।”

ট্রাম্পের বক্তব্যে আপাত শান্তি ও কূটনীতির বার্তা থাকলেও, বাস্তবে ইরান–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এখনো গভীর অবিশ্বাসে আচ্ছন্ন। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ, নিষেধাজ্ঞা, এবং আঞ্চলিক রাজনীতির জটিলতায় এই ‘বন্ধুত্বের হাত’ সত্যিই চুক্তিতে রূপ নেবে কি না, তা এখনো সময়ের অপেক্ষা।