১০:০৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইউরোপীয় গুপ্তচর ‘আবদুল গফ্ফার’-এর মক্কা অভিযান

🔹 ইসলামগ্রহণকারী ইউরোপীয় ‘গুপ্তচর’

১৮৮৪ সালের ২৮ আগস্ট, নেদারল্যান্ডসের তরুণ এক ব্যক্তি জেদ্দা উপকূলে এসে পৌঁছান। বয়স তখন ২৭। উদ্দেশ্য: হজযাত্রী সেজে মক্কায় প্রবেশ করা এবং ইন্দোনেশিয়ান মুসলমানদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে নিজের দেশের সরকারকে পাঠানো। তার নাম ক্রিশ্চিয়ান সনুক হারখ্রোনয়ে।

এই তরুণ ছিলেন ডাচ সরকারপ্রেরিত একজন গুপ্তচর। তার মিশন ছিল মক্কায় গিয়ে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ অঞ্চলের হজযাত্রীদের ওপর নজর রাখা, কারণ ডাচ সরকার আশঙ্কা করছিল— এরা মক্কার আলেমদের কাছ থেকে উপনিবেশবিরোধী প্রেরণা নিয়ে দেশে ফিরে আসতে পারে।

🔹 ধর্মান্তরের অভিনয়

লাইডেন ইউনিভার্সিটির ধর্মতত্ত্বে পিএইচডি করা হারখ্রোনয়ে, ইসলাম বিষয়ে বিস্তৃত জ্ঞান রাখতেন। মক্কা সফরের জন্য তাকে মুসলিম পরিচয় নিতে হয়। তাই তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নতুন নাম রাখেন আবদুল গফ্ফার।

তার সহচর হিসেবে সাথে ছিলেন ইন্দোনেশিয়ান গুপ্তচর রাদান আবু বকর দেজাজি দিনরত, যিনি জেদ্দায় পাঁচ বছর ধরে বসবাস করছিলেন।

🔹 মক্কায় প্রবেশ ও অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষণ

জেদ্দার উসমানীয় গভর্নর ও বিচারকের আস্থাভাজন হয়ে তিনি ১৮৮৫ সালের ২১ জানুয়ারি মক্কায় প্রবেশের অনুমতি পান। তখন মক্কা অটোমান সাম্রাজ্যের কঠোর নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। সেখানে তিনি সাত মাস অবস্থান করেন, মুফতি, আলেম ও সাধারণ মুসলমানদের সঙ্গে মেলামেশা করেন, নামাজ আদায় করেন এবং বিশেষত ইন্দোনেশিয়ান জাভানিজ জনগোষ্ঠী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন।

🔹 ইতিহাসের প্রথম ইউরোপীয় আলোকচিত্রী ও রেকর্ডকারী

মক্কা অবস্থানকালে তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ফটোগ্রাফি ও শব্দ রেকর্ডিং। তার সঙ্গে ছিল ৪০ কেজির ক্যামেরা। তিনি কিছু ছবি নিজে তোলেন, বাকিগুলো স্থানীয় চক্ষুবিশেষজ্ঞ সইদ আবদুল গফ্ফর আল-বাগদাদি পরবর্তীতে তুলে পাঠান। তার তোলা প্রথম ছবিগুলোর একটি ২০১৯ সালে ২ লক্ষ ১২ হাজার পাউন্ডে নিলামে বিক্রি হয়।

তিনি শুধু ছবি নয়, মক্কায় শব্দও রেকর্ড করেছিলেন— যার মধ্যে একটি ছিল কুরআনের সূরার প্রথম রেকর্ডিং। সবকিছুই বর্তমানে লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত রয়েছে।

🔹 দ্বৈত জীবন ও বিতর্ক

হারখ্রোনয়ে পরবর্তীতে স্বীকার করেন— ইসলাম গ্রহণ তার জন্য কৌশলগত ছিল। তিনি মক্কায় একজন মুসলিম স্ত্রী রেখে যান এবং পরে ইন্দোনেশিয়ায় আরেকজনকে বিয়ে করেন। ইতিহাসবিদ পিটার জর্ডন ভান কনিংসভেল্ড ও মাজহার ইকবাল মনে করেন, তিনি একটি দ্বৈত জীবন যাপন করতেন— ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক বৃত্তে একরূপ, মুসলিম সমাজে আরেকরূপ।

ইন্দোনেশিয়ায় ফিরে তিনি মুসলিম আলেমদের নিয়ন্ত্রণ ও ইসলামী শিক্ষা সীমিত করার নীতিমালা প্রণয়ন করেন। ফলে তিনি ডাচ উপনিবেশে গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা হয়ে ওঠেন।

🔹 উত্তরাধিকার ও মূল্যায়ন

তিনি “মক্কা ইন দ্য ল্যাটার পার্ট অফ নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি” নামের দুই খণ্ডে বই লিখেন, যা ঐতিহাসিক ও দৃষ্টিনন্দন ছবি, ধ্বনি ও পর্যবেক্ষণে ভরপুর। কেউ কেউ তাকে একজন গুপ্তচর ও সুবিধাবাদী মনে করেন, আবার কেউ কেউ তাকে একজন পণ্ডিত, পর্যবেক্ষক এবং প্রাচ্যবিদ বলে বিবেচনা করেন।

তার কাজ মক্কার ইতিহাস সংরক্ষণে একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যদিও তার ইসলাম গ্রহণ ছিল এক বিতর্কিত নাট্যাংশ।

তিনি ১৯৩৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ইসলামি রীতিতে দাফন করা হয়।

✧ উপসংহার:
ইউরোপীয় এই অভিযাত্রীর গল্প একদিকে যেমন ইসলামি ভূমিতে তার দুঃসাহসিক অভিযান তুলে ধরে, তেমনি পশ্চিমা উপনিবেশবাদ ও ধর্মের ব্যবহারের এক জটিল বাস্তবতাকেও উন্মোচিত করে। ইতিহাসে এমন চরিত্র বিরল, যারা একইসঙ্গে গুপ্তচর, পণ্ডিত, আলোকচিত্রী এবং বিতর্কের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছেন।

ট্যাগ

ইউরোপীয় গুপ্তচর ‘আবদুল গফ্ফার’-এর মক্কা অভিযান

প্রকাশিত হয়েছে: ০৭:০০:৪৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫

🔹 ইসলামগ্রহণকারী ইউরোপীয় ‘গুপ্তচর’

১৮৮৪ সালের ২৮ আগস্ট, নেদারল্যান্ডসের তরুণ এক ব্যক্তি জেদ্দা উপকূলে এসে পৌঁছান। বয়স তখন ২৭। উদ্দেশ্য: হজযাত্রী সেজে মক্কায় প্রবেশ করা এবং ইন্দোনেশিয়ান মুসলমানদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে নিজের দেশের সরকারকে পাঠানো। তার নাম ক্রিশ্চিয়ান সনুক হারখ্রোনয়ে।

এই তরুণ ছিলেন ডাচ সরকারপ্রেরিত একজন গুপ্তচর। তার মিশন ছিল মক্কায় গিয়ে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ অঞ্চলের হজযাত্রীদের ওপর নজর রাখা, কারণ ডাচ সরকার আশঙ্কা করছিল— এরা মক্কার আলেমদের কাছ থেকে উপনিবেশবিরোধী প্রেরণা নিয়ে দেশে ফিরে আসতে পারে।

🔹 ধর্মান্তরের অভিনয়

লাইডেন ইউনিভার্সিটির ধর্মতত্ত্বে পিএইচডি করা হারখ্রোনয়ে, ইসলাম বিষয়ে বিস্তৃত জ্ঞান রাখতেন। মক্কা সফরের জন্য তাকে মুসলিম পরিচয় নিতে হয়। তাই তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নতুন নাম রাখেন আবদুল গফ্ফার।

তার সহচর হিসেবে সাথে ছিলেন ইন্দোনেশিয়ান গুপ্তচর রাদান আবু বকর দেজাজি দিনরত, যিনি জেদ্দায় পাঁচ বছর ধরে বসবাস করছিলেন।

🔹 মক্কায় প্রবেশ ও অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষণ

জেদ্দার উসমানীয় গভর্নর ও বিচারকের আস্থাভাজন হয়ে তিনি ১৮৮৫ সালের ২১ জানুয়ারি মক্কায় প্রবেশের অনুমতি পান। তখন মক্কা অটোমান সাম্রাজ্যের কঠোর নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। সেখানে তিনি সাত মাস অবস্থান করেন, মুফতি, আলেম ও সাধারণ মুসলমানদের সঙ্গে মেলামেশা করেন, নামাজ আদায় করেন এবং বিশেষত ইন্দোনেশিয়ান জাভানিজ জনগোষ্ঠী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন।

🔹 ইতিহাসের প্রথম ইউরোপীয় আলোকচিত্রী ও রেকর্ডকারী

মক্কা অবস্থানকালে তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ফটোগ্রাফি ও শব্দ রেকর্ডিং। তার সঙ্গে ছিল ৪০ কেজির ক্যামেরা। তিনি কিছু ছবি নিজে তোলেন, বাকিগুলো স্থানীয় চক্ষুবিশেষজ্ঞ সইদ আবদুল গফ্ফর আল-বাগদাদি পরবর্তীতে তুলে পাঠান। তার তোলা প্রথম ছবিগুলোর একটি ২০১৯ সালে ২ লক্ষ ১২ হাজার পাউন্ডে নিলামে বিক্রি হয়।

তিনি শুধু ছবি নয়, মক্কায় শব্দও রেকর্ড করেছিলেন— যার মধ্যে একটি ছিল কুরআনের সূরার প্রথম রেকর্ডিং। সবকিছুই বর্তমানে লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত রয়েছে।

🔹 দ্বৈত জীবন ও বিতর্ক

হারখ্রোনয়ে পরবর্তীতে স্বীকার করেন— ইসলাম গ্রহণ তার জন্য কৌশলগত ছিল। তিনি মক্কায় একজন মুসলিম স্ত্রী রেখে যান এবং পরে ইন্দোনেশিয়ায় আরেকজনকে বিয়ে করেন। ইতিহাসবিদ পিটার জর্ডন ভান কনিংসভেল্ড ও মাজহার ইকবাল মনে করেন, তিনি একটি দ্বৈত জীবন যাপন করতেন— ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক বৃত্তে একরূপ, মুসলিম সমাজে আরেকরূপ।

ইন্দোনেশিয়ায় ফিরে তিনি মুসলিম আলেমদের নিয়ন্ত্রণ ও ইসলামী শিক্ষা সীমিত করার নীতিমালা প্রণয়ন করেন। ফলে তিনি ডাচ উপনিবেশে গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা হয়ে ওঠেন।

🔹 উত্তরাধিকার ও মূল্যায়ন

তিনি “মক্কা ইন দ্য ল্যাটার পার্ট অফ নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি” নামের দুই খণ্ডে বই লিখেন, যা ঐতিহাসিক ও দৃষ্টিনন্দন ছবি, ধ্বনি ও পর্যবেক্ষণে ভরপুর। কেউ কেউ তাকে একজন গুপ্তচর ও সুবিধাবাদী মনে করেন, আবার কেউ কেউ তাকে একজন পণ্ডিত, পর্যবেক্ষক এবং প্রাচ্যবিদ বলে বিবেচনা করেন।

তার কাজ মক্কার ইতিহাস সংরক্ষণে একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যদিও তার ইসলাম গ্রহণ ছিল এক বিতর্কিত নাট্যাংশ।

তিনি ১৯৩৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ইসলামি রীতিতে দাফন করা হয়।

✧ উপসংহার:
ইউরোপীয় এই অভিযাত্রীর গল্প একদিকে যেমন ইসলামি ভূমিতে তার দুঃসাহসিক অভিযান তুলে ধরে, তেমনি পশ্চিমা উপনিবেশবাদ ও ধর্মের ব্যবহারের এক জটিল বাস্তবতাকেও উন্মোচিত করে। ইতিহাসে এমন চরিত্র বিরল, যারা একইসঙ্গে গুপ্তচর, পণ্ডিত, আলোকচিত্রী এবং বিতর্কের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছেন।