
ইরান-ইসরায়েল চলমান সংঘাতে রীতিমতো আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন ইসরায়েলে বসবাসরত হাজার হাজার ভারতীয় নাগরিক। কেউ কেয়ার গিভার, কেউ নির্মাণ শ্রমিক, কেউ প্রযুক্তি বা চিকিৎসা খাতে কর্মরত—তবে সকলেরই অভিজ্ঞতা এখন একটাই: “কখন কোথা থেকে ক্ষেপণাস্ত্র এসে পড়বে, বলা যায় না।”
দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের বাসিন্দা রাঘবেন্দ্র নাইক ইসরায়েলের তেল আভিভ শহরে গত ১৩ বছর ধরে কেয়ার গিভারের কাজ করছেন। বিবিসি বাংলার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন,
“আমার ছয় বছরের মেয়েটাকে বহুদিন দেখিনি। ভেবেছিলাম সামনে মাসে দেশে যাব। কিন্তু ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ বেঁধে গেল। এখন সব অনিশ্চিত।”
নাইক বলেন, রাতের বেলা তাদের বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে হচ্ছে। ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সাইরেনের শব্দ শুনে নীচে দৌড়ে যেতে হয়।
“গত কয়েক রাত আমি বা আশপাশের কেউই ঘুমাতে পারিনি,”—বলছিলেন তিনি।
🇮🇳 ইসরায়েলে ভারতীয়দের উপস্থিতি: এক নজরে
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলে আনুমানিক ১৮,০০০ থেকে ২০,০০০ ভারতীয় নাগরিক বিভিন্ন খাতে কাজ করছেন। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। ২০২৩ সালে ভারত-ইসরায়েল দ্বিপাক্ষিক শ্রমচুক্তি স্বাক্ষরের পর এই সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটে।
২০২৫ সালের ১০ মার্চ পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ৬,৬৯৪ জন ভারতীয় এই চুক্তির আওতায় ইসরায়েলে পৌঁছেছেন।
তাদের মধ্যে অনেকেই কাজ করছেন নির্মাণ ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে। প্রায় ১৯৫টি ইসরায়েলি কোম্পানি ভারতীয় কর্মী নিয়োগ করেছে।
👩⚕️ কেয়ার গিভার: ভারতীয়দের প্রধান ভূমিকা
ইসরায়েলের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর দেখভালে সবচেয়ে বেশি নির্ভর করা হয় ভারতীয় কেয়ার গিভারদের উপর। নার্স, নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট ও হোম হেল্পার হিসাবে ভারতীয়দের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
ইন্ডিয়ান ইকনোমিক ট্রেড অর্গানাইজেশনের প্রেসিডেন্ট ড. আসিফ ইকবাল জানান,
“প্রবীণদের দেখাশোনার জন্য ইসরায়েলে যথেষ্ট লোক নেই। তাই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ভারতীয় কেয়ার গিভারদের উপর ভরসা করতে হয়।”
৮০ বছর বয়সী ইসরায়েলি নাগরিক নিসিন মোসেরি বলেন,
“আমার ছেলেরা আমেরিকায় থাকে। আমাকে কেয়ার গিভারই দেখাশোনা করে। এমনকি বোমা পড়ার ভয়ে বাঙ্কারে নেমে যাওয়ার সময়ও তাকেই পাশে পেতে হয়।”
🏗️ নির্মাণ খাতেও বাড়ছে ভারতীয় শ্রমিকের চাহিদা
ইসরায়েলের নির্মাণ শিল্পেও এখন ভারতীয় শ্রমিকদের চাহিদা তুঙ্গে। বিশেষ করে গাজা যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনি শ্রমিকরা নিষিদ্ধ হওয়ায় এই খাতে তৈরি হয়েছে জনবলের শূন্যতা। ফলে কাঠামো নির্মাণ, লোহা বাঁকানো ও প্লাস্টারিং-এর মতো কাজে ভারতীয় শ্রমিকদের ব্যাপকভাবে নিয়োগ করা হচ্ছে।
ড. ইকবাল বলেন,
“নির্মাণ খাতে কর্মী প্রয়োজন এখন প্রচুর। তবে সংখ্যায় এখনও তা কেয়ার গিভারের তুলনায় কম।”
💻 তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কিছু ভারতীয়
যদিও তুলনামূলকভাবে কম, তবু তথ্যপ্রযুক্তি ও ইঞ্জিনিয়ারিং খাতেও কিছু ভারতীয় পেশাজীবী রয়েছেন। তাঁরা মূলত তেল আভিভ ও আশপাশের প্রযুক্তি হাবে নিয়োজিত।
🌍 ইসরায়েল কেন? কর্মক্ষেত্র হিসেবে দেশটির আকর্ষণ কী?
পিএন লরেন্স নামে এক ভারতীয় নাগরিক জানান,
“আমি ইসরায়েলে ১৩ বছর কেয়ার গিভারের কাজ করেছি। সাময়িকভাবে যুক্তরাজ্যে এলেও আবার ইসরায়েলে ফিরে যাব। কারণ এখানে মাইনে বেশি, সুযোগ-সুবিধাও ভালো।”
তিনি আরও বলেন,
“স্বাস্থ্যবিমা, সাপ্তাহিক ছুটি, আর নিয়মিত বেতন—এসব সুবিধা ভারতীয়দের জন্য বড় ভরসা। আমাদের উপার্জনের উপরেই ভারতে থাকা পরিবারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।”
🕍 ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইহুদি এবং অভিবাসন ধারাবাহিকতা
বর্তমানে ইসরায়েলে প্রায় ৮৫,০০০ ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইহুদি বসবাস করছেন। তারা মূলত মহারাষ্ট্র, কেরালা, কলকাতা, মণিপুর ও মিজোরাম থেকে অভিবাসিত।
আইস্যাক ওয়াস্কার নামের একজন প্রবীণ ব্যক্তি ১৯৬৩ সালে মুম্বাই থেকে ইসরায়েলে যান। তিনি বলেন,
“গাজার যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনি শ্রমিকরা আর কাজ করতে পারছেন না। সেই ঘাটতি পূরণ করছে ভারতীয়রা।”
⚠️ ইসরায়েলে যুদ্ধ পরিস্থিতি: চরম আতঙ্কের জীবন
বর্তমানে ইসরায়েলের অভ্যন্তরেই চলমান আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ভারতীয় কর্মীদের মধ্যেও।
তেল আভিভে অবস্থানরত ভারতীয় ব্যবসায়ী বেন্নি নাইডু বলেন,
“আমরা প্রতি সপ্তাহে উৎসব করি, কথা বলি। কিন্তু এখন কেউই শান্তিতে নেই। ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষ পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলেছে।”
নাগরিকত্বপ্রাপ্ত অনেক ভারতীয়ও ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। তাদের সন্তানরাও বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক সেবায় থাকছেন।
🏡 ফেরার সিদ্ধান্ত: অনেকেই এখন ফিরতে চাইছেন ভারতে
রাঘবেন্দ্র নাইক জানিয়েছেন,
“আগে বছরে একবার দেশে যেতে পারতাম। এখন সেটা অসম্ভব। তাই ঠিক করেছি—পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে ভারতে ফিরে যাব। সেখানেই নতুন করে কাজ খুঁজব।”
ইসরায়েলস্থিত ইন্ডিয়ান জিউইশ কমিউনিটি সেন্টারের প্রেসিডেন্ট আইস্যাক ওয়াস্কার জানান,
“সম্প্রতি আমার পরিচিত কয়েকজন নিহত হয়েছেন ক্ষেপণাস্ত্র হামলায়। তাদের মধ্যে সেনাবাহিনীতে থাকা তরুণরাও ছিল।”
🔚 উপসংহার: পেশার টানে আসা, এখন অনিশ্চয়তার ছায়া
ইসরায়েল বহু ভারতীয়ের জন্য ছিল একটি নিরাপদ ও লাভজনক কর্মস্থল। কিন্তু ক্রমাগত যুদ্ধ, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, সাইরেনের শব্দ এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ অনেককেই চিন্তায় ফেলেছে।
“চতুর্দিকে মৃত্যু ফাঁদ। কোথায় যাব?”—এই প্রশ্ন এখন যেন হাজার হাজার ভারতীয়ের মনের গভীরে গেঁথে আছে।