০৪:০৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

১২ বছর মুছে গেল স্মৃতি থেকে, স্ত্রী-সন্তানকেও চিনতে পারলেন না পিয়ের

টাইম ট্রাভেল নিয়ে বহু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী শোনা গেলেও বাস্তবে তা অসম্ভব বলেই বিবেচিত। কিন্তু ইতালির চিকিৎসক ড. পিয়েরদান্তে পিকিওনির জীবনে এমন কিছু ঘটেছিল, যা অনেকের কাছেই টাইম ট্রাভেলের মতোই বিস্ময়কর মনে হয়। ২০১৩ সালে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় তার মাথায় মারাত্মক আঘাত লাগে। সে আঘাতের ফলেই তার মস্তিষ্ক থেকে মুছে যায় টানা ১২ বছরের স্মৃতি।

জ্ঞান ফেরার পর, পিয়েরদান্তে মনে করেছিলেন তখন ২০০১ সাল চলছে। হাসপাতালে চোখ মেলার পর তিনি চেনা মুখগুলোকে অচেনা মনে করলেন। স্ত্রীকে চিনতে পারলেন না, ছেলেদেরও মনে হলো অজানা কেউ। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তিনি নিজেই ছিলেন সেই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রধান। অথচ সেই জায়গাটিকেও নিজের বলে মনে হচ্ছিল না।

তাকে যখন বর্তমান প্রযুক্তি, যেমন ট্যাবলেট বা আইপ্যাড দেখানো হলো, তখন তিনি বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যান। কারণ ২০০১ সালের স্মৃতিতে এসব ডিভাইসের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এক পর্যায়ে তিনি বুঝতে পারেন, সময় বদলে গেছে, প্রযুক্তি এগিয়ে গেছে—আর তার জীবন থেকেও অনেক কিছু হারিয়ে গেছে।

সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসে তখন, যখন তার স্ত্রী জানায় যে তার মা তিন বছর আগে মারা গেছেন। আর তখনই তিনি বুঝতে পারেন যে তার বয়স এখন ৬৫, যদিও মনে হচ্ছিল তিনি এখনো ৫৩ বছরের তরুণ। এই সত্য মেনে নেওয়া তার জন্য ছিল মানসিকভাবে ভীষণ কঠিন।

তবে পিয়ের কেবল এই ক্ষতি মেনে নেননি, তিনি খুঁজে বের করতে চেয়েছেন এই হারানো ১২ বছরে তিনি কেমন মানুষ ছিলেন। এজন্য তিনি পড়েন প্রায় ৭৬ হাজার ইমেইল। একসময় তিনি বুঝতে পারেন, তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন না। সহকর্মীরা তাকে ডাকত “Prince of Bastards” নামে—মানে এক নিষ্ঠুর, কঠোর, রূঢ় মানুষ।

এই তথ্য তার কাছে ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তিনি নিজেই বলেছিলেন, “আমি কখনো ভাবিনি আমি খারাপ মানুষ হতে পারি।” কিন্তু বাস্তবতা মেনে নিয়েই তিনি সিদ্ধান্ত নেন—এবার থেকে একজন ভালো মানুষ হিসেবেই নিজেকে গড়বেন।

এ কারণেই তিনি ডায়েরি লেখা শুরু করেন। প্রতিদিন নিজের অনুভূতি, ছোট-বড় অভিজ্ঞতা লিখে রাখতেন। তিনি বলেন, “আমি নিজেকে এক ভুল সময়ের ভুল মানুষ মনে করতাম। এই দুনিয়াটা আমার বলে মনে হতো না। আমি একা অনুভব করতাম, যেন আমি কোনো ভিনগ্রহ থেকে এসেছি।”

এই মানসিক অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে তিনি এমনকি আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে আলো খুঁজে পান। পরিবার, ভালোবাসা এবং জীবনের নতুন মানে খুঁজে পেতে শুরু করেন।

এমনই এক মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারেন, তিনি আবার নিজের স্ত্রীকে ভালোবেসে ফেলেছেন। তিনি বলেন, “আমি মনে করি আমি একমাত্র মানুষ, যে তার স্ত্রীকেই দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়েছে। কারণ সে এখন এক নতুন মানুষ, আর আমিও।” এই প্রেমই তাকে নতুন করে জীবন শুরু করতে অনুপ্রাণিত করে।

তার এই অভূতপূর্ব জীবনের গল্প এতটাই বিস্ময়কর ও মানবিক যে, তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইতালিতে নির্মিত হয়েছে একটি টিভি সিরিজ। যেখানে ঠিক একইভাবে একজন তরুণ ডাক্তার গুলিবিদ্ধ হয়ে ১২ বছরের স্মৃতি হারিয়ে ফেলে।

পিয়ের এখন নিজের নতুন বাস্তবতা ও অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। তিনি শুধু চিকিৎসক নন, এখন তিনি একজন আত্ম-উপলব্ধিসম্পন্ন মানুষ, যিনি অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন হাজারো মানুষের জন্য।


ট্যাগ

শিক্ষা ভবনের সামনে সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

১২ বছর মুছে গেল স্মৃতি থেকে, স্ত্রী-সন্তানকেও চিনতে পারলেন না পিয়ের

প্রকাশিত হয়েছে: ১০:২৪:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ জুলাই ২০২৫

টাইম ট্রাভেল নিয়ে বহু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী শোনা গেলেও বাস্তবে তা অসম্ভব বলেই বিবেচিত। কিন্তু ইতালির চিকিৎসক ড. পিয়েরদান্তে পিকিওনির জীবনে এমন কিছু ঘটেছিল, যা অনেকের কাছেই টাইম ট্রাভেলের মতোই বিস্ময়কর মনে হয়। ২০১৩ সালে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় তার মাথায় মারাত্মক আঘাত লাগে। সে আঘাতের ফলেই তার মস্তিষ্ক থেকে মুছে যায় টানা ১২ বছরের স্মৃতি।

জ্ঞান ফেরার পর, পিয়েরদান্তে মনে করেছিলেন তখন ২০০১ সাল চলছে। হাসপাতালে চোখ মেলার পর তিনি চেনা মুখগুলোকে অচেনা মনে করলেন। স্ত্রীকে চিনতে পারলেন না, ছেলেদেরও মনে হলো অজানা কেউ। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তিনি নিজেই ছিলেন সেই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রধান। অথচ সেই জায়গাটিকেও নিজের বলে মনে হচ্ছিল না।

তাকে যখন বর্তমান প্রযুক্তি, যেমন ট্যাবলেট বা আইপ্যাড দেখানো হলো, তখন তিনি বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যান। কারণ ২০০১ সালের স্মৃতিতে এসব ডিভাইসের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এক পর্যায়ে তিনি বুঝতে পারেন, সময় বদলে গেছে, প্রযুক্তি এগিয়ে গেছে—আর তার জীবন থেকেও অনেক কিছু হারিয়ে গেছে।

সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসে তখন, যখন তার স্ত্রী জানায় যে তার মা তিন বছর আগে মারা গেছেন। আর তখনই তিনি বুঝতে পারেন যে তার বয়স এখন ৬৫, যদিও মনে হচ্ছিল তিনি এখনো ৫৩ বছরের তরুণ। এই সত্য মেনে নেওয়া তার জন্য ছিল মানসিকভাবে ভীষণ কঠিন।

তবে পিয়ের কেবল এই ক্ষতি মেনে নেননি, তিনি খুঁজে বের করতে চেয়েছেন এই হারানো ১২ বছরে তিনি কেমন মানুষ ছিলেন। এজন্য তিনি পড়েন প্রায় ৭৬ হাজার ইমেইল। একসময় তিনি বুঝতে পারেন, তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন না। সহকর্মীরা তাকে ডাকত “Prince of Bastards” নামে—মানে এক নিষ্ঠুর, কঠোর, রূঢ় মানুষ।

এই তথ্য তার কাছে ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তিনি নিজেই বলেছিলেন, “আমি কখনো ভাবিনি আমি খারাপ মানুষ হতে পারি।” কিন্তু বাস্তবতা মেনে নিয়েই তিনি সিদ্ধান্ত নেন—এবার থেকে একজন ভালো মানুষ হিসেবেই নিজেকে গড়বেন।

এ কারণেই তিনি ডায়েরি লেখা শুরু করেন। প্রতিদিন নিজের অনুভূতি, ছোট-বড় অভিজ্ঞতা লিখে রাখতেন। তিনি বলেন, “আমি নিজেকে এক ভুল সময়ের ভুল মানুষ মনে করতাম। এই দুনিয়াটা আমার বলে মনে হতো না। আমি একা অনুভব করতাম, যেন আমি কোনো ভিনগ্রহ থেকে এসেছি।”

এই মানসিক অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে তিনি এমনকি আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে আলো খুঁজে পান। পরিবার, ভালোবাসা এবং জীবনের নতুন মানে খুঁজে পেতে শুরু করেন।

এমনই এক মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারেন, তিনি আবার নিজের স্ত্রীকে ভালোবেসে ফেলেছেন। তিনি বলেন, “আমি মনে করি আমি একমাত্র মানুষ, যে তার স্ত্রীকেই দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়েছে। কারণ সে এখন এক নতুন মানুষ, আর আমিও।” এই প্রেমই তাকে নতুন করে জীবন শুরু করতে অনুপ্রাণিত করে।

তার এই অভূতপূর্ব জীবনের গল্প এতটাই বিস্ময়কর ও মানবিক যে, তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইতালিতে নির্মিত হয়েছে একটি টিভি সিরিজ। যেখানে ঠিক একইভাবে একজন তরুণ ডাক্তার গুলিবিদ্ধ হয়ে ১২ বছরের স্মৃতি হারিয়ে ফেলে।

পিয়ের এখন নিজের নতুন বাস্তবতা ও অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। তিনি শুধু চিকিৎসক নন, এখন তিনি একজন আত্ম-উপলব্ধিসম্পন্ন মানুষ, যিনি অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন হাজারো মানুষের জন্য।